বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি অন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি। এই হোক, আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলী। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতের বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নীরিহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নাম ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিনত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে-হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয় যাবে, আমার গাট-ছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেক জনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋন, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা, নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীট্সের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। তুই প্রস্তুত হ!” জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য কতদিন অকারনণ অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি, কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত। মেঘের ঊর্ধ্বে শূন্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে- ঠিক সেই দিনই সেই সময়ে আমার বাড়ীতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণ ভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলুম। আমার কাব্য, আমার গান, আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।
যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শূন্য হতে অসময়ে নেমে আসতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন, পূর্ণত্যের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল। যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারেই বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে, আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।
যেদিন আমি চলে যাব- সেদিন হয়তো বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে। দেশ-প্রেমিক, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী বিশেষনণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে, বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা-পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো- বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না
নিশ্চল, নিশ্চুপ,
আপনার মনে পুড়িব একাকী
গন্ধ-বিধূর ধূপ”।