তপসিবনী বৈশাখ প্রায় শেষ হইয়া আসিল। প্রথম রাত্রে গমট গেছে, বাঁশগাছের পাতাটা পৰ্যন্ত নড়ে না, আকাশের তারাগুলো যেন মাথা-ধরার বেদনার মতো দব দব করিতেছে। রাত্রি তিনটের সময় ঝির ঝির করিয়া একটখানি বাতাস উঠিল। ষোড়শী শান্য মেঝের উপর খোলা জানালার নীচে শুইয়া আছে, একটা কাপড়ে-মোড়া টিনের বাক্স তার মাথার বালিশ। বেশ বোঝা যায়, খুব উৎসাহের সঙ্গে সে কৃচ্ছসাধন করিতেছে। প্রতিদিন ভোর চারটের সময় উঠিয়া স্নান সারিয়া ষোড়শী ঠাকুরঘরে গিয়া বসে। আহিক করিতে বেলা হইয়া যায়। তার পরে বিদ্যারত্নমশায় আসেন; সেই ঘরে বসিয়াই তাঁর কাছে সে গীতা পড়ে। সংস্কৃত সে কিছু কিছু শিখিয়াছে। শঙ্করের বেদান্তভাষ্য এবং পাতঞ্জলদশন মল গ্রন্থ হইতে পড়িবে, এই তার পণ। বয়স তার তেইশ হইবে। ঘরকন্নার কাজ হইতে ষোড়শী অনেকটা তফাত থাকে—সেটা যে কেন সম্ভব হইল তার কারণটা লইয়াই এই গল্প। নামের সঙ্গে মাখনবাবরে স্বভাবের কোনো সাদৃশ্য ছিল না। তাঁর মন গলানো বড়ো শক্ত ছিল। তিনি ঠিক করিয়াছিলেন, যতদিন তাঁর ছেলে বরদা অন্তত বি.এ. পাস না করে ততদিন তাঁর বউমার কাছ হইতে সে দরে থাকিবে। অথচ পড়াশনাটা বরদার ঠিক ধাতে মেলে না, সে মানষেটি শৌখিন। জীবননিকুঞ্জের মধ্য-সঞ্চয়ের সম্বন্ধে মৌমাছির সঙ্গে তার মেজাজটা মেলে, কিন্তু মৌচাকের পালায় ষে পরিশ্রমের দরকার সেটা তার একেবারেই সয় না। বড়ো আশা করিয়াছিল, বিবাহের পর হইতে গোঁফে তা দিয়া সে বেশ একটু আরামে থাকিবে, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটগুলো সদরেই ফকিবার সময় আসিবে। কিন্তু, কপালক্রমে বিবাহের পরে তার মঙ্গলসাধনের ইচ্ছা তার বাপের মনে আরও বেশি প্রবল হইয়া উঠিল। ইস্কুলের পণ্ডিতমশায় বরদার নাম দিয়াছিলেন, গোতম মনি। বলা বাহুল্য, সেটা বরদার ব্রহ্মতেজ দেখিয়া নয় । কোনো প্রশ্নের সে জবাব দিত না বলিয়াই তাকে তিনি মনি বলিতেন এবং যখন জবাব দিত তখন তার মধ্যে এমন কিছ গব্য পদার্থ পাওয়া যাইত যাতে পণ্ডিতমশায়ের মতে তার গোতম উপাধি সাথক श्रॅग्नाझिञ । মাখন হেডমাস্টারের কাছে সন্ধান লইয়া জানিলেন, ইস্কুল এবং ঘরের শিক্ষক এইরপ বড়ো বড়ো দই এঞ্জিন আগে পিছে জড়িয়া দিলে তবে বরদার সম্পাতি হইতে পারে। অধম ছেলেদের যাঁরা পরীক্ষাসাগর তরাইয়া দিয়া থাকেন এমন-সব নামজাদা মাস্টার রাত্রি দশটা সাড়ে-দশটা পৰ্যন্ত বরদার সঙ্গে লাগিয়া রহিলেন। সত্যযুগে সিখিলাভের জন্য বড়ো বড়ো তপস্বী যে তপস্যা করিয়াছে সে ছিল একলার তপস্যা, কিন্তু মাস্টারের সঙ্গে মিলিয়া বরদার এই-ষে যৌথ তপস্যা এ তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃসহ। সে কালের তপস্যার প্রধান উত্তাপ ছিল অগ্নিকে লইয়া; এখনকার এই পরীক্ষা-তাপসের তাপের প্রধান কারণ অনিশমারা ; তারা বরদাকে বড়ো জনলাইল । তাই এত দুঃখের পর যখন সে পরীক্ষায় ফেল করিল তখন তার o গল্পগুচ্ছ সান্না হইল এই ষে, সে যশস্বী মাস্টারমশায়দের মাথা হে’ট করিয়াছে। কিন্তু, এমন অসামান্য নিলফলতাতেও মাখনবাব হাল ছাড়িলেন না। দ্বিতীয় বছরে আরএক দল মাস্টার নিযুক্ত হইল; তাঁদের সঙ্গে রফা হইল এই যে, বেতন তো তাঁরা পাইবেনই, তার পরে বরদা যদি ফারস্ট ডিবিসনে পাস করিতে পারে তবে তাঁদের বকশিশ মিলিবে। এবারেও বরদা যথাসময়ে ফেল করিত, কিন্তু এই আসন্ন দীঘটনাকে একট বৈচিত্র্য স্বারা সরস করিবার অভিপ্রায়ে একজামিনের ঠিক আগের রাত্রে পাড়ার কবিরাজের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সে একটা কড়া রকমের জোলাপের বড়ি খাইল এবং ধন্বন্তরীর কৃপায় ফেল করিবার জন্য তাকে আর সেনেট-হল পর্যন্ত ছটিতে হইল না, বাড়ি বসিয়াই সে কাজটা বেশ সসম্পন্ন হইতে পারিল। রোগটা উচ্চ-অঙ্গের সাময়িক পত্রের মতো এমনি ঠিক দিনে ঠিক সময়ে প্রকাশ হইল যে, মাখন নিশ্চয় বুঝিল এ কাজটা বিনা সম্পাদকতায় ঘটিতেই পারে না। এ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা না করিয়া তিনি বরদাকে বলিলেন যে, তৃতীয়বার পরীক্ষার জন্য তাকে প্রস্তুত হইতে হইবে। অথাৎ তার সশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ আরও একটা বছর বাড়িয়া গেল । অভিমানের মাথায় বরদা একদিন খাব ঘটা করিয়া ভাত খাইল না। তাহাতে ফল হইল এই, সন্ধ্যাবেলাকার খাবারটা তাকে আরও বেশি করিয়া খাইতে হইল। মাখনকে সে বাঘের মতো ভয় করিত, তব মরিয়া হইয়া তাঁকে গিয়া বলিল, “এখানে থাকলে আমার পড়াশুনো হবে না।” মাখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় গেলে সেই অসম্পভব ব্যাপার সম্ভব হতে পারবে ?” সে বলিল, “বিলাতে।” মাখন তাকে সংক্ষেপে বঝোইবার চেষ্টা করিলেন, এ সম্বন্ধে তার যে গোলটক আছে সে ভূগোলে নয়, সে মগজে। স্বপক্ষের প্রমাণস্বরপে বরদা বলিল, তারই একজন সতীর্থ এনট্রেস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর শেষ বেঞ্চিটা হইতে একেবারে এক লাফে বিলাতের একটা বড়ো একজামিন মারিয়া আনিয়াছে। মাখন বলিলেন, বরদাকে বিলাতে পাঠাইতে তাঁর কোনো আপত্তি নাই কিন্তু তার আগে তার বি.এ. পাস করা চাই । - এও তো বড়ো মুশকিল! বি.এ. পাস না করিয়াও বরদা জমিয়াছে, বি.এ. পাস না করিলেও সে মরিবে, অথচ জন্মমৃত্যুর মাঝখানটাতে কোথাকার এই বি. এ. পাস বিন্ধ্যপবতের মতো খাড়া হইয়া দাঁড়াইল ; নড়িতে-চড়িতে সকল কথায় ঐখানটাতে গিয়াই ঠোকর খাইতে হইবে ? কলিকালে অগস্ত্য মনি করিতেছেন কী। তিনিও কি জটা মড়াইয়া বি.এ. পাসে লাগিয়াছেন। খুব একটা বড়ো দীঘনিশবাস ফেলিয়া বরদা বলিল, বার বার তিনবার ; এইবার কিন্তু শেষ। আর-একবার পেন্সিলের দাগ-দেওয়া কী-বইগলো তাকের উপর হইতে পাড়িয়া লইয়া বরদা কোমর বধিতে প্রবত্ত হইতেছে এমন সময় একটা আঘাত পাইল, সেটা আর তার সহিল না। স্কুলে যাইবার সময় গাড়ির খোঁজ করিতে গিয়া সে খবর পাইল যে, স্কুলে যাইবার গাড়ি-ঘোড়াটা মাখন বেচিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি বলেন, দই বছর লোকসান গেল, কত আর এই খরচ টানি " স্কুলে হাঁটিয়া যাওয়া বরদার পক্ষে लुकीज्यन्त्री 을 কিছুই শক্ত নয়, কিন্তু লোকের কাছে এই অপমানের সে কাঁ কৈফিয়ত দিবে। • অবশেষে অনেক চিন্তার পর একদিন ভোরবেলায় তার মাথায় আসিল, এ সংসারে মৃত্যু ছাড়া আর-একটা পথ খোলা আছে যেটা বি.এ. পাসের অধীন নয় এবং যেটাতে দারা সতে ধন জন সম্পণে অনাবশ্যক। সে আর কিছ নয়, সন্ন্যাসী হওয়া। এই চিন্তাটার উপর কিছুদিন ধরিয়া গোপনে সে বিস্তর সিগারেটের ধোঁয়া লাগাইল, তার পর একদিন দেখা গেল স্কুলঘরে মেঝের উপর তার কী-বইয়ের ছোড়া টুকরোগলো পরীক্ষাদ্বগের ভগ্নাবশেষের মতো ছড়ানো পড়িয়া আছে—পরীক্ষাথীর দেখা নাই । টেবিলের উপর এক-টকরা কাগজ ভাঙা কাঁচের গেলাস দিয়া চাপা, তাহাতে লেখা--- - ‘আমি সন্ন্যাসী— আমার আর গাড়ির দরকার হইবে না। শ্ৰীযন্ত বরদানন্দস্বামী। মাখনবাব কিছুদিন কোনো খোঁজই করিলেন না। তিনি ভাবিলেন, বরদাকে দরকার নাই। দরজা খোলাই রহিল, কেবল সেই কী-বইগলার ছোড়া টকরা সাফ হইয়া গেছে—আর-সমস্ত ঠিক আছে। ঘরের কোণে সেই জলের কুজার উপরে কানা-ভাঙা গেলাসটা উপড়ে করা ; তেলের-দাগে-মলিন চৌকিটার আসনের জায়গায় ছারপোকার উৎপাত ও জীণতার হলটি-মোচনের জন্য একটা পরাতন অ্যাটলাসের মলাট পাতা; এক ধারে একটা শান্য প্যাকবাক্সের উপর একটা টিনের তোরঙ্গে বরদার নাম অাঁকা; দেয়ালের গায়ে তাকের উপর একটা মলাট-ছে’ড়া ইংরেজি-বাংলা ডিক্সনারি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভারতবর্ষের ইতিহাসের কতকগলো পাতা, এবং মলাটে রানী ভিক্টোরিয়ার মুখ-অাঁকা অনেকগুলো এক্সেসাইজ বই। এই খাতা ঝাড়িয়া দেখিলে ইহার অধিকাংশ হইতে অগডেন কোম্পানির সিগারেট-বাক্স-বাহিনী বিলাতি নটীদের মতি ঝরিয়া পড়িবে। সন্ন্যাস-আশ্রয়ের সময় পথের সান্ত্ৰনার জন্য এগুলো যে বরদা সঙ্গে লয় নাই তাহা হইতে বুঝা যাইবে তার মন প্রকৃতিস্থ ছিল না। আমাদের নায়কের তো এই দশা ; নায়িকা ষোড়শী তখন সবেমাত্র রয়োদশী। বাড়িতে শেষ পৰ্যন্ত সবাই তাকে খচকি বলিয়া ডাকিত, শ্বশুরবাড়িতেও সে আপনার এই চিরশৈশবের খাতি লইয়া আসিয়াছিল, এইজন্য তার সামনেই বরদার চরিত্র-সমালোচনায় বাড়ির দাসীগুলোর পষত বাধিত না। শাশুড়ি ছিলেন চিররগণা– কতার কোনো বিধানের উপরে কোনো কথা বলিবার শক্তি তাঁর ছিল না, এমন-কি, মনে করিতেও তাঁর ভয় করিত। পিস শাশুড়ির ভাষা ছিল খুব প্রখর ; বরদাকে লইয়া তিনি খুব শক্ত শক্ত কথা খুব চোখা চোখা করিয়া বলিতেন, তার বিশেষ একট কারণ ছিল । পিতামহদের আমল হইতে কৌলীন্যের অপদেবতার কাছে বংশের মেয়েদের বলি দেওয়া এ বাড়ির একটা প্রথা। এই পিসি যার ভাগে পড়িয়াছিলেন সে একটা প্রচণ্ড গাঁজাখোর। তার গণের মধ্যে এই যে, সে বেশিদিন বাঁচে নাই। তাই আদর করিয়া ষোড়শীকে তিনি যখন মক্কাহারের সঙ্গে তুলনা করিতেন তখন অত্যামী বঝিতেন, বাথ মন্তাহারের জন্য যে আক্ষেপ সে একা যোড়শীকে লইয়া নয়। এ ক্ষেত্রে মন্তাহারের যে বেদনাবোধ আছে সে কথা সকলে ভুলিয়াছিল। পিসি ** গল্পগুচ্ছ বলিতেন, দাদা কেন যে এত মাস্টার-পণ্ডিতের পিছনে খরচ করেন তা তো বুঝি নে। লিখে পড়ে দিতে পারি, বরদা কখনোই পাস করতে পারবে না। পরিবে না এ বিশ্বাস ষোড়শীরও ছিল, কিন্তু সে একমনে কামনা করিত যেন কোনো গতিকে পাস করিয়া বরদা অন্তত পিসির মাখের ঝাজটা মারিয়া দেয়। বরদা প্রথমবার ফেল করিবার পর মাখন যখন দ্বিতীয়বার মাস্টারের বাহ বধিবার চেষ্টায় লাগিলেন–পিসি বলিলেন, ধন্য বলি দাদাকে ! মানুষ ঠেকেও তো শেখে। তখন ষোড়শী দিনরাত কেবল এই অসম্ভব-ভাবনা ভাবিতে লাগিল, বরদা এবার যেন হঠাৎ নিজের আশ্চর্য গোপন শক্তি প্রকাশ করিয়া অবিশ্ববাসী জগৎটাকে সতভিত করিয়া দেয় ; সে যেন প্রথম শ্রেণীতে সব-প্রথমের চেয়েও আরও আরও আরও অনেক বড়ো হইয়া পাস করে—এত বড়ো যে, স্বয়ং লাটসাহেব সওয়ার পাঠাইয়া দেখা করিবার জন্য তাহাকে তলব করেন । এমন সময়ে কবিরাজের অব্যৰ্থ বড়িটা ঠিক পরীক্ষাদিনের মাথার উপর যুদ্ধের বোমার মতো আসিয়া পড়িল। সেটাও মন্দের ভালো হইত যদি লোকে সন্দেহ না করিত। পিসি বলিলেন, ছেলের এ দিকে বধি নেই, ও দিকে আছে। লাটসাহেবের তলব পড়িল না। ষোড়শী মাথা হে’ট করিয়া লোকের হাসাহাসি সহ্য করিল। সময়োচিত জোলাপের প্রহসনটায় তার মনেও যে সন্দেহ হয় নাই এমন কথা বলিতে পারি না। এমন সময় বরদা ফেরার হইল। ষোড়শী বড়ো আশা করিয়াছিল, অন্তত এই ঘটনাকেও বাড়ির লোকে দীঘটনা জ্ঞান করিয়া অনন্তাপ পরিতাপ করিবে। কিন্তু, তাহাদের সংসার বরদার চলিয়া যাওয়াটাকেও পরা দাম দিল না। সবাই বলিল, এই দেখো-না, এল বলে! ষোড়শী মনে মনে বলিতে লাগিল, কখখনো না! ঠাকুর, লোকের কথা মিথ্যা হোক! বাড়ির লোককে যেন হায়-হায় করতে হয় ! এইবার বিধাতা ষোড়শীকে বর দিলেন ; তার কামনা সফল হইল। এক মাস গেল, বরদার দেখা নাই; কিন্তু তব কারও মখে কোনো উদবেগের চিহ্ন দেখা যায় না। দই মাস গেল, তখন মাখনের মনটা একট চঞ্চল হইয়াছে, কিন্তু বাহিরে সেটা কিছুই প্রকাশ করিলেন না। বউমার সঙ্গে চোখাচোখি হইলে তাঁর মুখে যদিবা বিষাদের মেঘ-সঞ্চার দেখা যায়, পিসির মুখ একেবারে জ্যৈষ্ঠমাসের অনাবটির আকাশ বলিলেই হয়। কাজেই সদর দরজার কাছে একটা মানুষ দেখিলেই ষোড়শী চমকিয়া ওঠে; আশঙ্কা, পাছে তার স্বামী ফিরিয়া আসে। এমনি করিয়া যখন তৃতীয় মাস কাটিল, করিলেন । এও ভালো, অবজ্ঞার চেয়ে রাগ ভালো। পরিবারের মধ্যে রুমে ভয় ও দুঃখ ঘনাইয়া আসিতে লাগিল। খোঁজ করিতে করিতে ক্ৰমে এক বছর যখন কাটিল তখন, মাখন যে বরদার প্রতি অনাবশ্যক কঠোরাচরণ করিয়াছেন সে কথা পিসিও বলিতে শর করিলেন । দুই বছর যখন গেল তখন পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলিতে লাগিল, বরদার পড়াশনায় মন ছিল না বটে কিন্তু মানুষটি বড়ো ভালো ছিল। বরদার আদর্শনকাল যতই দীঘ হইল ততই, তার স্বভাব যে অত্যন্ত নিমাল ছিল, এমন-কি সে যে তামাকটা পর্যন্ত খাইত না, এই অন্ধ বিশ্বাস পাড়ার লোকের মনে বম্বমল হইতে লাগিল। স্কুলের পণ্ডিতমশায় স্বয়ং বলিলেন, এইজন্যই তো তিনি বরদাকে গোতম মনি নাম দিয়াছিলেন, তখন হইতেই উহার বন্ধি বৈরাগ্যে একেবারে নিরেট হইয়া ছিল। পিসি প্রত্যহই অন্তত একবার করিয়া তাঁর দাদার জেদী মেজাজের পরে দোষরোপ তপসিবনী 3 করিয়া বলিতে লাগিলেন, বরদার এত লেখাপড়ার দরকারই বা কী ছিল। টাকার তো অভাব নাই। যাই বল বাপ, তার শরীরে কিন্তু দোষ ছিল না। আহা, সোনার টুকরো ছেলে " তার স্বামী ষে পবিত্রতার আদশ ছিল এবং সংসারসন্ধি সকলেই তার প্রতি অন্যায় করিয়াছে, সকল দুঃখের মধ্যে এই সাম্বনায়, এই গৌরবে ষোড়শীর মন ভরিয়া উঠিতে লাগিল । এ দিকে বাপের ব্যথিত হাদয়ের সমস্ত স্নেহ বিগণ করিয়া ষোড়শীর উপর আসিয়া পড়িল । বউমা যাতে সুখে থাকে, মাখনের এই একমাত্র ভাবনা। তাঁর বড়ো ইচ্ছা, ষোড়শী তাকে এমন-কিছু ফরমাশ করে যেটা দলভ— অনেকটা কষ্ট করিয়া, লোকসান করিয়া, তিনি তাকে একটু খুশি করিতে পারিলে যেন বাঁচেন— তিনি এমন করিয়া ত্যাগ স্বীকার করিতে চান যেটা তাঁর পক্ষে প্রায়শ্চিত্তের মতো হইতে পারে। २ ষোড়শী পনেরো বছরে পড়িল । ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া যখন-তখন তার চোখ জলে ভরিয়া আসে। চিরপরিচিত সংসারটা তাকে চারি দিকে যেন অটিয়া ধরে, তার প্রাণ হাঁপাইয়া ওঠে । তার ঘরের প্রত্যেক জিনিসটা, তার বারান্দার প্রত্যেক রেলিঙটা, আলিসার উপর যে-কয়টা ফলের গাছের টব চিরকাল ধরিয়া খাড়া দাঁড়াইয়া আছে, তারা সকলেই যেন অন্তরে অন্তরে তাকে বিরক্ত করিতে থাকিত। পদে পদে ঘরের করে; সমস্ত জিনিসপত্রের উপর তার রাগ হইতে থাকে। সংসারে তার একমাত্র আরামের জায়গা ছিল ঐ জানালার কাছটা। যে বিশ্ববটা তার বাহিরে সেইটেই ছিল তার সব চেয়ে আপন । কেননা, তার ঘর হইল বাহির, বাহির হইল ঘর ' - একদিন যখন বেলা দশটা— অতঃপরে যখন বাটি, বারকোষ, ধামা, চুপড়ি, শিলনোড়া ও পানের বাক্সের ভিড় জমাইয়া ঘরকন্নার বেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে—এমন সময় সংসারের সমস্ত ব্যস্ততা হইতে স্বতন্ত্র হইয়া জানলার কাছে ষোড়শী আপনার উদাস মনকে শান্য আকাশে দিকে দিকে রওনা করিয়া দিতেছিল। হঠাৎ জয় বিশ্বেশ্বর বলিয়া হকি দিয়া এক সন্ন্যাসী তাহদের গেটের কাছের অশথতলা হইতে বাহির হইয়া আসিল। ষোড়শীর সমস্ত দেহতন্তু মীড়টানা বীণার তারের মতো চরম ব্যাকুলতায় বাজিয়া উঠিল। সে ছটিয়া আসিয়া পিসিকে বলিল, “পিসিমা, ঐ সন্ন্যাসীঠাকুরের ভোগের আয়োজন করো ।” এই শরে হইল। সন্ন্যাসীর সেবা ষোড়শীর জীবনের লক্ষ্য হইয়া উঠিল। এতদিন পরে শবশরের কাছে বধর আবদারের পথ খলিয়াছে। মাখন উৎসাহ দেখাইয়া বলিলেন, বাড়িতে বেশ ভালোরকম একটা অতিথিশালা খোলা চাই । মাখনবাবরে কিছকাল হইতে আয় কমিতেছিল; কিন্তু, তিনি বারো টাকা সদে ধার করিয়া সৎকমে' লাগিয়া গেলেন । - সন্ন্যাসীও যথেষ্ট জটিতে লাগিল। তাদের মধ্যে অধিকাংশ যে খাঁটি নয়, মাখনের সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু, বউমার কাছে তার আভাস দিবার জো কী। বিশেষত: 8 গল্পগুচ্ছ জটাধারীরা যখন আহার-আরামের অপরিহায্য ক্রটি লইয়া গালি দেয়, অভিশাপ দিতে ওঠে, তখন এক-একদিন ইচ্ছা হইত তাদের ঘাড়ে ধরিয়া বিদায় করিতে। কিন্তু, ষোড়শীর মুখ চাহিয়া তাহাদের পায়ে ধরিতে হইত। এই ছিল তাঁর কঠোর প্রায়শ্চিত্ত। সন্ন্যাসী আসিলেই প্রথমে অন্তঃপরে একবার তার তলব পড়িত। পিসি তাকে লইয়া বসিতেন, ষোড়শী দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিত। এই সাবধানতার কারণ ছিল এই, পাছে সন্ন্যাসী তাকে প্রথমেই মা বলিয়া ডাকিয়া বসে। কেননা, কী জানি — বরদার যে ফোটোগ্রাফখানি ষোড়শীর কাছে ছিল সেটা তার ছেলে-বয়সের। সেই বালকমখের উপর গোঁফদাড়ি জটাজট ছাইভস্ম যোগ করিয়া দিলে সেটার যে কিরকম অভিব্যক্তি হইতে পারে তা বলা শক্ত। কতবার কত মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছে, বুঝি কিছ কিছু মেলে; বকের মধ্যে রক্ত দ্রুত বহিয়াছে, তার পরে দেখা যায়-কণ্ঠস্বরে ঠিক মিল নাই, নাকের ডগার কাছটা অন্যরকম। এমনি করিয়া ঘরের কোণে বসিয়াও নতন নতন সন্ন্যাসীর মধ্য দিয়া ষোড়শী যেন বিশ্বজগতে সন্ধানে বাহির হইয়াছে। এই সন্ধানই তার সখে। এই সন্ধানই তার স্বামী, তার জীবনযৌবনের পরিপন্ণতা। এই সন্ধানটিকেই ঘেরিয়া তার সংসারের সমস্ত আয়োজন। সকালে উঠিয়া ইহারই জন্য তার সেবার কাজ আরম্ভ হয়— এর আগে রান্নাঘরের কাজ সে কখনো করে নাই, এখন এই কাজেই তার বিলাস । সমস্তক্ষণই মনের মধ্যে তার প্রত্যাশার প্রদীপ জালানো থাকে। রাত্রে শইতে যাইবার আগে, কাল হয়তো আমার সেই অতিথি আসিয়া পেপছিবে এই চিন্তাটিই তার দিনের শেষ চিন্তা । এই যেমন সন্ধান চলিতেছে, অমনি সেই সঙ্গে যেমন করিয়া বিধাতা তিলোত্তমাকে গড়িয়াছিলেন তেমনি করিয়া ষোড়শী নানা সন্ন্যাসীর শ্রেষ্ঠ উপকরণ মিলাইয়া বরদার মতিটিকে নিজের মনের মধ্যে উজলে করিয়া তুলিতেছিল। পবিত্র তার সত্তা, তেজঃপুঞ্জ তার দেহ, গভীর তার জ্ঞান, অতি কঠোর তার ব্রত। এই সন্ন্যাসীকে অবজ্ঞা করে এমন সাধ্য কার। সকল সন্ন্যাসীর মধ্যে এই এক সন্ন্যাসীরই তো পজা চলিতেছে। স্বয়ং তার বশরও যে এই পাজার প্রধান পাজারী, ষোড়শীর কাছে এর চেয়ে গৌরবের कथा श्राव्र-किछ्द झिल ना । কিন্তু সন্ন্যাসী প্রতিদিনই তো আসে না। সেই ফাঁকগুলো বড়ো অসহ্য। ক্ৰমে সে ফাঁকও ভরিল। ষোড়শী ঘরে থাকিয়াই সন্ন্যাসের সাধনায় লাগিয়া গেল। সে মেঝের উপর কবল পাতিয়া শোয়, এক বেলা যা খায় তার মধ্যে ফলমলেই বেশি। গায়ে তার গেরয়া রঙের তসর, কিন্তু সাধব্যের লক্ষণ ফটাইয়া তুলিবার জন্য চওড়া তার লাল পাড়, এবং কল্যাণীর সিথির অধোকটা জড়িয়া মোটা একটা সিন্দরের রেখা। ইহার উপরে শ্বশুরকে বলিয়া সংস্কৃত পড়া শরে করিল। মগধবোধ মুখপথ করিতে তার অধিক দিন লাগিল না; পণ্ডিতমশায় বলিলেন, একেই বলে পাব'জমোজিত বিদ্যা। পবিত্রতার সে যতই অগ্রসর হইবে সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার অন্তরের মিলন ততই পর্ণ হইতে থাকিবে, এই সে মনে মনে ঠিক করিয়াছিল। বাহিরের লোকে সকলেই ধন্য-ধন্য করিতে লাগিল; এই সন্ন্যাসী সাধার সাধনী দীর পায়ের ধলা ও আশীবাদ লইবার লোকের ভিড় বাড়িতে থাকিল--এমন-কি, স্বয়ং পিসিও তার কাছে ভয়ে সম্প্রমে চুপ করিয়া থাকেন। কিন্তু ষোড়শী যে নিজের মন জানিত। তার মনের রঙ তো তার গায়ের তসরের তপস্বিনী a &&. রঙের মতো সম্পণে গেরয়া হইয়া উঠিতে পারে নাই। আজ ভোর বেলাটাতে ঐ-যে ঝির ঝির করিয়া ঠাণ্ডা হাওয়া দিতেছিল সেটা যেন তার সমস্ত দেহমনের উপর কোন একজনের কানে কানে কথার মতো আসিয়া পেপছিল। উঠিতে আর ইচ্ছা করিতেছিল না। জোর করিয়া উঠিল, জোর করিয়া কাজ করিতে গেল। ইচ্ছা করিতেছিল, জানালার কাছে বসিয়া তার মনের দরে দিগন্ত হইতে যে বাঁশির সরে আসিতেছে সেইটে চুপ করিয়া শোনে। এক-একদিন তার সমস্ত মন যেন অতিচেতন হইয়া ওঠে, রৌদ্রে নারিকেলের পাতাগুলো ঝিলমিল করে, সে যেন তার বকের মধ্যে কথা কহিতে থাকে। পণ্ডিতমশায় গীতা পড়িয়া ব্যাখ্যা করিতেছেন, সেটা ব্যথ হইযা যায় ; অথচ সেই সময়ে তার জানালার বাহিরের বাগানে শকনো পাতার উপর দিয়া যখন কাঠবিড়ালি খস খস করিয়া গেল, বহদের আকাশের হৃদয় ভেদ করিয়া চিলের একটা তীক্ষ ডাক আসিয়া পৌছিল, ক্ষণে ক্ষণে পকৃেরপাড়ের রাস্তা দিয়া গোরুর গাড়ি চলার একটা ক্লান্ত শব্দ বাতাসকে আবিট করিল, এই-সমস্তই তার মনকে পশ* করিয়া অকারণে ব্যাকুল করে । একে তো কিছুতেই বৈরাগ্যের লক্ষণ বলা যায় না। যে বিস্তীর্ণ জগৎটা তপত প্রাণের জগৎ– পিতামহ ব্ৰহ্মার রক্তের উত্তাপ হইতেই যার আদিম বাপ আকাশকে ছাইয়া ফেলিতেছিল, যা তাঁর চতুমীথের বেদবেদান্ত-উচ্চারণের অনেক পবের সন্টি, যার রঙের সঙ্গে ধনির সঙ্গে গন্ধের সঙ্গে সমস্ত জীবের নাড়ীতে নাড়ীতে বোঝাপড়া হইয়া গেছে, তারই ছোটো বড়ো হাজার হাজার দত জীবহৃদয়ের খাসমহলে আনাগোনার গোপন পথটা জানে— ষোড়শী তো কৃচ্ছসাধনের কাঁটা গাড়িয়া আজও সে পথ বন্ধ করিতে পারিল না। কাজেই গেরয়া রঙকে আরও ঘন করিয়া গুলিতে হইবে। ষোড়শী পণ্ডিতমশায়কে ধরিয়া পড়িল, “আমাকে যোগাসনের প্রণালী বলিয়া দিন।” পণ্ডিত বলিলেন, “মা, তোমার তো এ-সকল পন্থায় প্রয়োজন নাই। সিন্ধি তো পাকা আমলকীর মতো আপনি তোমার হাতে আসিয়া পৌছিয়াছে।” তার পণ্যেপ্রভাব লইয়া চারি দিকে লোকে বিস্ময় প্রকাশ করিয়া থাকে, ইহাতে ষোড়শীর মনে একটা স্তবের নেশা জমিয়া গেছে। এমন একদিন ছিল, বাড়ির ঝিচাকর পর্যন্ত তাকে কৃপাপাত্রী বলিয়া মনে করিয়াছে। তাই আজ যখন তাকে পণ্যবতী বলিয়া সকলে ধন্য-ধন্য করিতে লাগিল তখন তার বহুদিনের গৌরবের তৃষ্ণা মিটিবার সযোগ হইল। সিন্ধি যে সে পাইয়াছে এ কথা অস্বীকার করিতে তার মুখে বাধে— তাই পণ্ডিতমশায়ের কাছে সে চুপ করিয়া রহিল। মাখনের কাছে ষোড়শী আসিয়া বলিল, “বাবা, আমি কার কাছে প্রাণায়াম অভ্যাস করিতে শিখি বলো তো ।” মাখন বলিলেন, “সেটা না শিখিলেও তো বিশেষ অসুবিধা দেখি না। তুমি যত দরে গেছ সেইখানেই তোমার নাগাল কজন লোকে পায়।” তা হউক, প্রাণায়াম অভ্যাস করিতেই হইবে। এমনি দ দৈব যে, মানুষও জটিয়া গেল। মাখনের বিশ্বাস ছিল, আধুনিক কালের অধিকাংশ বাঙালিই মোটামুটি তাঁরই মতো— অথাৎ খায়-দায়, ঘামায়, এবং পরের কুৎসাঘটিত ব্যাপার ছাড়া জগতে আরকোনো অসম্ভবকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু, প্রয়োজনের তাগিদে সন্ধান করিতে গিয়া দেখিল, বাংলাদেশে এমন মানুষও আছে যে ব্যক্তি খলনা জেলায় ভৈরব নদের ধারে 8 ●ミや গল্পগুচ্ছ খাঁটি নৈমিষারণা আবিস্কার করিয়াছে। এই আবিস্কারটা যে সত্য তার প্রধান প্রমাণ, ইহা কৃষ্ণপ্রতিপদের ভোরবেলায় সবনে প্রকাশ পাইয়াছে। স্বয়ং সরস্বতী ফাঁস করিয়া দিয়াছেন। তিনি যদি নিজবেশে আসিয়া আবিভূতি হইতেন তাহা হইলে বরঞ্চ সন্দেহের কারণ থাকিত—কিন্তু, তিনি তাঁর আশ্চযা দেবীলীলায় হাঁড়িচাঁচা পাখি হইয়া দেখা দিলেন। পাখির লেজে তিনটি মাত্র পালক ছিল—একটি সাদা, একটি সবুজ, মাঝেরটি পাটকিলে। এই পালক তিনটি যে সত্ত্ব রজ তম, ঋক যজঃ সাম, সন্টি স্থিতি প্রলয়, আজ কাল পরশ প্রভৃতি যে তিন সংখ্যার ভেলিক লইয়া এই জগৎ তাহারই নিদর্শন তাহাতে সন্দেহ ছিল না। তার পর হইতে এই নৈমিষারণ্যে যোগী তৈরি হইতেছে । দুইজন এম.এসসি. ক্লাসের ছেলে কলেজ ছাড়িয়া এখানে যোগ অভ্যাস করেন; একজন সাবজজ তাঁর সমস্ত পেন্সেন এই নৈমিষারণ্য-ফন্ডে উৎসগা করিয়াছেন এবং তাঁহার পিতৃমাতৃহীন ভাগনেটিকে এখানকার যোগী ব্রহ্মচারীদের সেবার জন্য নিযুক্ত করিয়া দিয়া মনে আশ্চয* শান্তি পাইয়াছেন। এই নৈমিষারণ্য হইতে ষোড়শীর জন্য যোগ-অভ্যাসের শিক্ষক পাওয়া গেল । সতরাং মাখনকে নৈমিষারণ্য-কমিটির গহী-সভ্য হইতে হইল। গহী-সভোর কতব্য, নিজের আয়ের ষষ্ঠ অংশ সন্ন্যাসী-সভ্যদের ভরণপোষণের জন্য দান করা। গহীসভ্যদের শ্রদ্ধার পরিমাণ-অনুসারে এই ষষ্ঠ অংশ অনেক সময় থামোমিটরের পারার মতো সত্য অঙ্কটার উপরে নীচে উঠানামা করে । অংশ কষিবার সময় মাখনেরও ঠিকে ভুল হইতে লাগিল। সেই ভুলটার গতি নীচের অঙ্কের দিকে। কিন্তু, এই ভুলচুকে নৈমিষারণ্যের যে ক্ষতি হইতেছিল ষোড়শী তাহা পরণ করিয়া দিল। ষোড়শীর গহনা আর বড়োকিছ বাকি রহিল না এবং তার মাসহারার টাকা প্রতি মাসে সেই অন্তহিত গহনাগুলোর অনুসরণ করিল। বাড়ির ডাক্তার অনাদি আসিয়া মাখনকে কহিলেন, “দাদা, করছ কাঁ। মেয়েটা যে মারা যাবে।” মাখন উদবিগ্ন মুখে বলিলেন, “তাই তো, কী করি।” ষোড়শীর কাছে তাঁর আর সাহস নাই। এক সময়ে অত্যন্ত মন্দ্বসত্বরে তাকে আসিয়া বলিলেন, “মা, এত অনিয়মে কি তোমার শরীর টিকবে।” ষোড়শী একটুখানি হাসিল। তার মমাথ এই, এমন-সকল ব্যথা উদবেগ সংসারী বিষয়ী লোকেরই যোগ্য বটে। 'ෆ বরদা চলিয়া যাওয়ার পরে বারো বৎসর পার হইয়া গেছে; এখন ষোড়শীর বয়স পাচিশ একদিন ষোড়শী তার যোগী শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, আমার স্বামী জীবিত আছেন কি না তা আমি কেমন করে জানব।” যোগী প্রায় দশ মিনিট কাল স্তম্ব হইয়া চোখ বজিয়া রহিলেন; তার পরে চোখ খালিয়া বলিলেন, “জীবিত আছেন।” “কেমন করে জানলেন।* - “সে কথা এখনো তুমি বঙ্কেবে না। কিন্তু, এটা নিশ্চয় জেনো, শীলোক হয়েও তপস্বিনী 이 সাধনার পথে তুমি যে এতদরে অগ্রসর হয়েছ সে কেবল তোমার স্বামীর অসামান্য তপোবলে। তিনি দরে থেকেও তোমাকে সহধর্মিণী করে নিয়েছেন।” ষোড়শীর শরীর-মন পলকিত হইয়া উঠিল। নিজের সম্বন্ধে তার মনে হইল, ঠিক যেন শিব তপস্যা করিতেছেন আর পাবতী পদ্মবীজের মালা জপিতে জপিতে ভাঁর জন্য অপেক্ষা করিয়া আছেন। ষোড়শী আবার জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি কোথায় আছেন তা কি জানতে পারি।” যোগী ঈষৎ হাস্য করিলেন; তার পরে বলিলেন, “একখানা আয়না নিয়ে এসো।” ষোড়শী আয়না আনিয়া যোগীর নির্দেশমত তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। আধ ঘণ্টা গেলে যোগী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু দেখতে পাচ্ছ ?” ষোড়শী বিধার স্বরে কহিল, “হা, যেন কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কী ভা পাট বঝেতে পারছি নে।” "সাদা কিছু দেখছ কি ” "সাদাই তো বটে।" “যেন পাহাড়ের উপর বরফের মতো ?” “নিশ্চয়ই বরফ ! কখনো পাহাড় তো দেখি নি, তাই এতক্ষণ ঝাপসা ঠেকছিল।” এইরুপ আশ্চৰ্য উপায়ে ক্ৰমে ক্ৰমে দেখা গেল, বরদা হিমালয়ের অতি দগম জায়গায় লংচু পাহাড়ে বরফের উপর অনাবত দেহে বসিয়া আছেন। সেখান হইতে তপস্যার তেজ ষোড়শীকে আসিয়া পশ করিতেছে, এই এক আশচয’ কাণ্ড । সেদিন ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া ষোড়শীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল । তার স্বামীর তপস্যা যে তাকে দিনরাত ঘেরিয়া আছে, স্বামী কাছে থাকিলে মাঝে মাঝে যে বিচ্ছেদ ঘটিতে পারিত সে বিচ্ছেদও যে তার নাই, এই আনন্দে তার মন ভরিয়া উঠিল। তার মনে হইল, সাধনা আরও অনেক বেশি কঠোর হওয়া চাই। এতদিন এবং পৌষ মাসটাতে ষে কবল সে গায়ে দিতেছিল এখনি সেটা ফেলিয়া দিতেই শাঁতে তার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল। ষোড়শীর মনে হইল, সেই লংচু পাহাড়ের হাওয়া তার গায়ে আসিয়া লাগিতেছে। হাত জোড় করিয়া চোখ বলজিয়া সে বসিয়া রহিল, চোখের কোণ দিয়া অজস্র জল পড়িতে লাগিল। সেইদিনই মধ্যাহ্নে আহারের পর মাখন ষোড়শীকে তাঁর ঘরে ডাকিয়া আনিয়া বড়োই সংকোচের সঙ্গে বলিলেন, “মা, এতদিন তোমার কাছে বলি নি, ভেবেছিলম দরকার হবে না, কিন্তু আর চলছে না। আমার সম্পত্তির চেয়ে আমার দেনা অনেক বেড়েছে, কোনদিন আমার বিষয় ক্লোক করে বলা যায় না।” ষোড়শীর মুখ আনন্দে দীপ্ত হইয়া উঠিল। তার মনে সন্দেহ রহিল না যে, এ-সমস্তই তার স্বামীর কাজ। তার স্বামী তাকে পণভাবে আপন সহধর্মিণী করিতেছেন--বিষয়ের বেটুকু ব্যবধান মাঝে ছিল সেও বাকি এবার ঘনচাইলেন ! কেবল উত্তরে হাওয়া নয়, এই-ষে দেনা এও সেই লংচু পাহাড় হইতে আসিয়া পোছিতেছে: এ তার স্বামীরই দক্ষিণ হাতের পশ"। সে হাসিমুখে বলিল, “ভয় কী বাবা!” মাখন বলিলেন, “আমরা দাঁড়াই কোথায়।” বোড়শী বলিল, “নৈমিষারণ্যে চালা বেধে থাকব।” . গল্পগুচ্ছ মাখন বঝিলেন, ইহার সঙ্গে বিষয়ের আলোচনা ব্যথা। তিনি বাহিরের ঘরে বসিয়া চুপ করিয়া তামাক টানিতে লাগিলেন। * এমন সময়ে মোটর গাড়ি দরজার কাছে আসিয়া থামিল। সাহেবি কাপড়পরা এক ধবো টপ করিয়া লাফাইয়া নামিয়া মাখনের ঘরে আসিয়া একটা অত্যন্ত অসম্পণে “এ কী। বরদা নাকি।” বরদা জাহাজের লস্কর হইয়া আমেরিকায় গিয়াছিল। বারো বংসর পরে সে আজ কোন-এক কাপড়-কাচা কল কোম্পানির ভ্রমণকারী এজেন্ট হইয়া ফিরিয়াছে। বাপকে বলিল, “আপনার যদি কাপড়-কাচা কলের দরকার থাকে খুব সস্তায় করে দিতে পারি।” বলিয়া ছবি-অাঁকা ক্যাটলগ পকেট হইতে বাহির করিল।