দুর্গাপূজা বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মালম্বীদের একটি বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। এটি পুনর্মিলন, নবজাগরণ এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি ও রীতিনীতি উদযাপনের জন্য একটি বিশেষ উপলক্ষ। দেবী দুর্গাকে আবাহনের সাধারণ সময় বসন্তকাল। চৈত্র (মার্চ-এপ্রিল) মাসের দুর্গাপূজাকে সংক্ষেপে বাসন্তী পূজা বলা হয়। দৈত্য রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে শরৎকালে রাম দেবী দুর্গার আবাহন করেন। অপ্রচলিত মৌসুমে এ পূজা, তাই, অকাল বোধন নামে পরিচিত। এই শারদ অনুষ্ঠান দুর্গাপূজা প্রতি বছর অশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে পালিত হয়। কার্যত, শারদীয় দুর্গাপূজাই বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান এবং সর্বাধিক সংখ্যায় অনুষ্ঠিত হয়।
শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গাকে বিল্ববৃক্ষে আরাধনা করে মন্ত্র পাঠান্তে পূজা নিবেদন করে বোধনের অনুষ্ঠান করা হয়। শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী—এ তিন দিন সাড়ম্বরে দেবী দুর্গার পূজা করা হয়। দেবীর ভোগ দেওয়া হয়, দেবীর আরতি করা হয়। অষ্টমীর দিন করা হয় কুমারী পূজা। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে করা হয় সন্ধিপূজা। সবশেষে দশমী পূজা। বলা হয় ‘বিজয়া দশমী’।
পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করল। প্রথমে বিষ্ণু ও পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই সঙ্গে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। সুউচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। এক-এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক-একটি অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক দেবতা তাঁদের অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহন সিংহ দান করলেন। দেবী ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল।
মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীর যোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তাঁর বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানারূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন, কিন্তু দেবী সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করল। দেবী বললেন, "রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।" এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তাঁর কণ্ঠে পা দিয়ে শূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।
দুর্গাপূজার রয়েছে বহুমুখী তাৎপর্য। সকল দেবতার মিলিত শক্তি হলেন দেবী দুর্গা। দুর্গতি থেকে ত্রাণের জন্য দেবতাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রতিমূর্ত রূপে প্রকাশ পায় দেবী দুর্গার প্রতীকে। দুর্বিনীত ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও প্রতিকার লাভের চেতনাই দুর্গোৎসবের মর্মবাণী। দেবী দুর্গা শক্তির প্রতীক। তাই দুর্গাপূজার মানে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপশক্তিকে নির্মূল করা।
ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। দুর্গাপূজা সার্বজনীন উৎসব। আমাদের দেশে দুর্গাপূজার উৎসবে অংশগ্রহণ করেন জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষ। এক মিলনমেলায় সবাই মিলিত হয়। দুর্গাপূজার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে এই উৎসব শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এর সার্বজনীনতা স্পর্শ করে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকেও। দুর্গাপূজার সকল অনুষ্ঠান সবার জন্য অবারিত। এই সার্বজনীন শারদোৎসবের তিথি মেনে পূজা টুকু খুব অল্প সময়ের জন্য; পূজার বাকি সবটুকু সময় সকল মানুষের জন্য কেবলই উৎসবের—সম্মিলনের, ভালোবাসার।
বাইরের অশুভ আসুরিক শক্তি জগৎ-সংসারে শান্তি-শৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটায়। ষড়রিপুর মতো ভেতরের আসুরিক শক্তির তাড়নায় মানুষ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়, কলুষিত হয় সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র। দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আশীর্বাণী নিয়ে আমরা যেন বাইরের এবং ভেতরের সব অপশক্তির বিনাশ করি। আমরা যেন গড়ে তুলতে পারি সুদৃঢ় বন্ধন, জাগিয়ে তুলতে পারি মানবিক গুণাবলী। সন্ত্রাস নির্মূল হোক, গড়ে উঠুক দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ। এই হোক শারদীয় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে আমাদের অঙ্গীকার ও প্রত্যাশা।