হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গেঁ গেল। রাত তখন ৩টা বাজে।খোলা জানালায় শুল্ক পক্ষের চাঁদের আলো উঁকি মারছে। কোন রকম অনুমতি প্রার্থনা ছাড়াই শির শির করে শীতল সমীকরণ প্রবেশ করছে ঘরে। দূর হতে ভেসে আসা একটা কুকুরের আর্তনাদ সুন্দর পরিবেশের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে আতঙ্কের আভাস। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে বেড়িয়ে এলাম বাইরে । এমন একটা পরিবেশে বাইরে হাঁটতে ইচ্ছা হল। বারান্দা হতে ওঠানে পা বাড়াতেই আবার কেমন একটা ভীতির সঞ্চার হল। পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়। চারিদিকে ভীষণ উত্তেজনা! কখন কি হয় বলা যায় না। কিন্তু এমন একটা সুন্দর মূহুর্ত হেলায় হারোনা যায় না। আমাদের গ্রামটাতে হিন্দু-মুসলমান মিলিত ভাবে পাহারা দেয় রাতে। সেদিক থেকে বেশ নিরাপদ। শার্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটাতে অগ্নি সংযোগ করে হাঁটতে শুরু করলাম। ভাবলাম নিরুকে সাথে নিয়ে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য অবলোকন করব আর উপভোগ করব অনাবিল আনন্দ।
ধীর গতিতে হেঁটে চলেছি হঠাৎ থেমে দাঁড়ালাম। নিরুদের বাড়ীর সামনের হিজল গাছটার নীচে দু’জন মানুষের মত চোখে পড়ল। স্বপ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। হিজলের পত্র পলবের মাঝ দিয়ে আপতিত ক্ষীন জোছনা লোকে কেবল অনুভব করা গেল বৃক্ষতলে দন্ডায়মান দু’জনের একজন মেয়ে মানুষ। একটা কাপড়ে মুখ ঢাকা মেয়েটি। ওদিক দিয়ে চলে গেলে দ্রুত। বৃক্ষ সারিরছায়ার মাঝ দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সে।
আর অন্য ব্যক্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো এদিকে। সিগারেটের ফিল্টাওে শেষ চুম্বন দিয়ে উচ্ছিষ্টাংশ ছুঁড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম কে? ওদিক থেকে চাপা কন্ঠে উত্তর এল আমি নিরু। ভালই হল, এখানেই পেয়ে গেলাম। তোর কাছে যাচ্ছিলাম। ও তুই! এ সময়ে হঠাৎ কি ভেবে? নিরু জানতে চাইল কিছুটা অবাক হয়ে। আমি এত রাতে আসার কারণ জানালাম। জিজ্ঞাসা করলাম ও কোথায় গিয়েছিল। কিন্তু ওর কাছ থেকে যে উত্তর এল সেটা আমার কাছে গ্রহন যোগ্য হল না। তবু আমি যা কিছু দেখেছিলাম সেটা মনেই চেপে রাখলাম। তারপর খানিক ক্ষন এদিক ওদিক হেঁটে বেড়ালাম দু’জন গল্প করলাম। তারপর কিছু সময় পরে বাড়ী ফিরে এলাম। নীরু আমার বাল্য বন্ধু ।সেহ শৈশব থেকে এক সাথে আমরা বড় হয়েছি। আমরা দু’জনেই বি.এ. পরীক্ষার্থী। কতবার আমরা ঝগড়া করেছি কতবার বন্ধুত্বের প্রতীজ্ঞা করেছি হিসেব নেই। আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস বোধও যথেষ্ট। কিন্তু কিছুক্ষন পূর্বে যে দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করলাম সেটা নীরু এড়িয়ে গেল কেন? কে এই মেয়ে? তবে কি নীরু আমার অজান্তে ...? না, তা কি করে সম্বব! বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। কোলাহলে যখন চৈতন্যোদয় হল তখন সকার ৯টা। চঁপট বিছানা ছেড়ে বাইরে এলাম। আমাদের উঠানে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ারই ৫/৭ জন। পাশের বাড়ীর আবিদ বলল, কিরে সোহেল বলল, লীনারা চলে গেছে শুনেছিস? চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম; চলে গেছে কোথায়? ‘ঠিক জানি না। বোধ হয় ভারতে। কাউকে কিছু না বলেই ওরা চলে গেছে। সকালে গিয়ে দেখে ওরা কেউ নেই।’ উত্তর করল আবিদ। আমাদের বাড়ীর এশবাড়ী পড়েই লীনাদের বাড়ী। ক্লাস নাইনে পড়ে ও। ওর মধ্যে যথেষ্ট চ লতা থাকলেও ছিল নম্র ব্যবহার। সুন্দর করে হাসি মুখে কথা বলতো সব সময়। তাই সবাই ওকে স্নেহও করত খুব। কিন্তু ক’দিন আগে যখন দাঙ্গাঁ শুরু হল দেশে তখন পাশের গ্রামের শাহীন যার মধ্যে রাজাকার পিতার পশুত্ব আর কুপ্রবৃত্তি বংশ পরস্পরায় স ারিত ও বিকশিত, সেই জানোয়ারটা সেদিন ওকে লাঞ্ছিত করতে চেয়েছিল। এ কারনেই হয়ত ওদের দেশ ত্যাগ। দাঁত ব্রাশ করছিলাম আর এসব কথা মাথায় খোর পাক খাচ্ছিল। হঠাৎ মার ডাকে চেতনা ফিওে পেয়ে মুখ ধুয়ে নাস্তা করতে গেলোম। প্রতিদিনের অভ্যাস বশত: নাস্তা শেষ করেই চলে গেলাম নীরুদের বাড়ি। মজা করার জন্য নি:শব্দে উঁিক মেরে দেখছিলাম ওর ঘরের সামনে গিয়ে দরজার ফাক দিয়ে বিছানায় বসে পাশ্ববর্তী খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে একটা ছবি হাতে নিয়ে বসে আছে নীরু। কিন্তু আমার আবিভার্ব উপলদ্ধি করেই ছবিটা লুকিয়ে ফেলল। আমি ঘরে প্রবেশ করলাম। স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল নীরু। ওযে একটা ছবি দেখছিল গভীর ভাবে এাঁ বুঝতে আমার মোটেও কষ্ট হল না। ব্যাপারটা জানতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু নীরু এড়িয়ে গেল। ছবিটা কোথায় লুকিয়েছিল সেটা আমি লক্ষ করেছিলাম। সুযোগ বুঝে হঠাৎ হস্তগত করলাম ছবিটা। মেলে ধরলাম চোখের সামনে, ছবিটা লীনার। নীরু ঝট করে আমার হাত দুটো চেপে ধরল। চোখ দুটো ছলছলে হয়ে উঠল, যেন এখনই অঝর ধারায় বর্ষন শুরু হবে। বিনীয় ভাবে বলল, আমি তোর কাছে ক্ষমা প্রার্থী সোহেল। আমাদের সম্পর্কটা তুই কিভাবে দেখবি এই ভেবে তোকে বলা হয়নি। আমি জানি, তোকে না জানিয়ে অন্যায় করেছি। আমি ওকে অভয় দিয়ে ভললাম আওে বোকা ছেলে, আমাকে জানাস নি তাতে দোষের কি হয়েছে? তারপর নীরু বলতে শুরু করল। নীরু তখন সবে বি.এ. ভর্তি হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই সঙ্গীতমনা ছিল সে। কন্ঠটাও ছিল দারুন। ওর কন্ঠের গানই প্রথম আকৃষ্ট করে লীনাকে। একই গ্রামের মেয়ে হিসেবে ভবাল সম্পর্ক থাকলেও ততটা ঘনিষ্টতা ছিল না আগে। নিরু ঘরের ভেতর রেওয়াজ করছিল। সুর ধারায় মুগ্ধ হয়ে এক অজানা টানে লীনা হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করেল। নীরু রেওয়াজ থামিয়ে বসতে বলল লীনাকে। লীনা নীরুর পড়ার টেবিলের পাশে দাঁড়ালো। চোখ পড়ল ফুলদানীর উপর।
এ ফুলটি মোটেও ভাল নয়। আচ্ছা আমি একটা ফুল এনে দিলে আপনি কি রাখবেন? লীনা সুধালো।
কেন রাখবো না।
তাহলে কাল একটা ফুল নিয়ে আসবো। তবে একটা গান শোনাতে হবে কিন্তু।
সে দেখা যাবে তুমি এসো কাল।
পরের দিন লীনা ঠিকই ফুল নিয়ে এলো। ফুলদানীর বাশি ফুলটি ফেলে দিয়ে সেখানে স্থাপন করল একগোছা রজনীগন্ধা তারপরই সে বায়না ধরল গান শুনবার। দুটো গান গাওয়ার পর অনেক ক্ষন ধরে গল্প হল দু’জনে। যাবার সময় লীনা একটা গোলাপ ফুল নীরুর হাতে দিয়ে গেল। লীনার বিদায়ী পথের দিকে চেয়ে চেয়ে গোলাপের গন্ধ শুকল নীরু। নাসিকা পথে বক্ষ অভ্যন্তর গামী বায়ুর সাথে ফুলের গন্ধ বক্ষ মধ্যে প্রবেশ করে নিরুর হৃদয়ে ছড়িয়ে দিল মিষ্টি সৌরভ। হঠাৎ কওে যেন অন্য রকম ভালো লাগল এই চ লতা মেয়েটিকে কৈশর থেকে সবে পর্দাপন করেছে যৌবনে! যত দিন গত হতে াকে ততই বাড়তে াকে ওদের ঘনিষ্টতা। ত্র“মে ত্র“মে নীরুর প্রতি লীনার ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নেয়। লীনার প্রতি তীক্ষè একটা দুর্বলতা জন্ম নেয় নীরুর মনে। উভয়েই তাদের ভালোবাসার কথা জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বলি বলি করেও বলা হয় না। শেষ পর্যন্ত লীনা ছোট্ট একটা চিঠি লেখল। সেটা নীরুর হাতে গুঁজে দিয়েই দৌড়ে চলে এলো। ব্যাকুল হয়ে নীরু পড়তে শুরু করল। খুব অল্প ক’টা কথা তাতে লেখা: নিরুদা, আগে আপনার গান আমি ভালোবাসতাম। কবে যে আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি ঠিক জানিনা। কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম আপনার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। স্বপ্ন কি স্বপ্ন হয়েই াকবে?- নির্লজ্জ মেয়েটি। চিঠি পড়ে উলাসে যেন আত্মহারা হয়ে গেল নীরু। সুখের বাতাস বয়ে গেল ওর হৃদয়ে। আপন করে নিল দু’জন দু;জনাকে। ওদের দুই হৃদয়ের মাঝে গড়ে উঠল এক সেতু বন্ধন। যেন কোন পাহাড়ী নদীর উত্তাল খরস্রোত কিংবা তীব্রভাবে ঘনীভূত কোন সাইক্লোন যেন পারবেনা ছিড়তে ওদের এই বন্ধনকে। সকল প্রকার কৃত্রিমতা বর্জিত হৃদয়ের প্রেম আর ভালোবাসায় গড়া এ বন্ধনের স্মারক স্তম্ভে লিখা হল হলো ভালোবাসার গভীরতম দৃপ্ত শপথ। তারপর সবার চোখ কে ফাকি দিয়ে এগিয়ে চললো ওদেও প্রেমময় জীবন। নতুন স্বপ্নেরা দিল ডানা মেলে। পরষ্পরের প্রেমের ছোয়ায় ওরা খুঁজে পেল জীবনের নতুন ঠিকানা। হঠাৎ সারাদেমে ছড়িয়ে দেওযা হল দাঙ্গাঁ। কিন্তু এরই মধ্যে একটি বিশেষ মহল মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের অবস্থান ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে সেই একটি মহলই বার বার তাদের স্বার্থ সিদ্ধির প্রয়োজনে সন্ধান করে নানা সুযোগের। আখের গোছানো অভিপ্রায়ে এবারও তারাই ছড়িয়ে দিল দাঙ্গাঁ। বাঙালীর স্বত্তা নিশ্চিত হল, কলঙ্কিত হল বাংলার গনতন্ত্র, আমাদের চিন্ত-চেতনা শিল্প ও কর্ম হল বিকৃত। ফাঁটল ধরল হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে সৃস্ট বন্ধনে যা গড়েউঠেছিল লাখো শহীদের বুকের রক্ত দিয়ে। সেদিন লীনা একা ফিরছিল স্কুল থেকে। পাশের গ্রামের শাহীন এসে সামনে দাঁড়ালো হঠাৎ। একটা ছুড়ি দেখিয়ে লাঞ্ছিত করতে চেষ্টা করল। লীনা হাতের বই গুলো শাহীনের মুখে নিক্ষেপ করে চিৎকার শুরু করল এবং দৌড়ে লোকজনের সামনে এসে পড়ল। সে দিন কার মত রক্ষা করল নিজেকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শাহীন আরও ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। লীনাদের বাড়ীর সামনে এসে হুমকি দিয়ে যায়। লীনার বাবা দিশেহারা হয়ে পড়লেন, কি করে তিনি রক্ষা করবেন তার মেয়েকে? লীনার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। শান্ত ও নিরীহ ধরনের মানুষ। একাত্তরে যুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে এ অ লে মুক্তিযোদ্ধাদেও যে দল গঠিত হয়েছিল সে দলের লোকজন লুটেরা-রাজাকার সাগীর মুন্সীর এক হাত কেটে দিয়েছিল, আর এই সাগীর মুন্সীই হল শাহীনের পিতা। এত বছর পর আজ সেই প্রতিশোধ নেবার বাসনায় বিবিধ পন্থায় চেষ্টা চালালো ওরা। তাই জীবনের নিরাপত্তা স্ত্রী-কন্যার সম্ভ্রম বাঁচানোর প্রয়োজনে তার প্রিয় গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন রিুদ্দেশে, নীরবে, গোপনে। যাবার আগে লীনা এক পাকে চলে এল নীরুদের হিজল গাছের নীচে। নীরুকে আগে থেকেই বলাছিল সব। প্রথম কিছুটা সময় কেউ কোন কথা বলল না। নীরবে মুখোমুখী চেয়ে াকল। তারপর লীনা বলল, “আজ আমি একটা জিনিস চাইলে দেবেন আপনি?” “বল কি চাও?” “আপনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার অনুমতি চাই।” বলেই লীনা নীচু হয়ে নিরুকে প্রনাম করল। নীরু বুকে জড়িয়ে ধরল লীনাকে। লীনা অস্ফুট স্বরে বলল, “এ কি হয়ে গেল নীরুদা।” “তুমি ভেবোনা লীনা। আবার দিন বদলাবে। তখন তুমি আমারই হবে। হৃদয়ের এ বাঁধন ছিড়বে না ; কিছুতেই না। আরও যেন কি বলতে চেয়েছিল, কিন্তু চোখের কোনে ক ফোটা পানি এসে কন্ঠটাকে রোধ করে দিল। বুকের মাঝে কোথায় যেন তীক্ষè একটা ব্যথা অনুভব করল। লীনা বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। সেই ব্যথাটা যেন ত্র“মশ নীরুর সমস্ত শরীরটাকে নিস্তেজ করে দিল।নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে একটা নিশাচর পাখী কেঁদে উঠলো।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাত তখন তিনটা। খোলা জানালায় শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো উঁকি মারছে। বিনা অনুমতিতেই যেন হিমেল বাতাস প্রবেশ করছে ঘরে। দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের আর্তনাদ শান্ত পরিবেশে আতঙ্কের আভাস ছড়াচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে বাইরে এলাম। এমন পরিবেশে একটু হাঁটতে ইচ্ছে হলো। বারান্দা থেকে পা বাড়াতেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল। পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। কখন কী ঘটে বলা যায় না। কিন্তু এমন সুন্দর একটা মুহূর্ত হেলায় হারাতে মন চাইল না।
আমাদের গ্রামটাতে হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলেমিশে রাতে পাহারা দেয়। তাই তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। শার্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরালাম, তারপর হাঁটতে শুরু করলাম। ভাবলাম, নীরুকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতির এই রূপ দেখব আর অনাবিল আনন্দে ডুব দেব।
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। নীরুদের বাড়ির সামনে হিজল গাছের নিচে দুটো অবয়ব চোখে পড়ল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু হিজলের পাতায় চাঁদের আলো পড়ে যে ক্ষীণ আলো তৈরি হয়েছে, তাতেই তাদের চেনা যাচ্ছিল। আমি একটু দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটি মুখ ঢাকা মেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই সে দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
অন্যজন ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কে?"
ওপাশ থেকে চাপা স্বরে উত্তর এল, "আমি নীরু।"
"তুই! এত রাতে এখানে?" আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
নীরু কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, "এই একই প্রশ্ন তো আমিও তোকে করতে পারি, তুই-ই বা এখানে কী করছিস?"
"এমনি," আমি বললাম। "একটা অনুভূতি হলো। আচ্ছা, যে মেয়েটা ছিল—"
নীরু কথা কেড়ে নিয়ে বলল, "তুই যা ভাবছিস, তেমন কিছু না।"
কিন্তু আমার মনে খটকা রয়েই গেল। ‘কেন এমনভাবে চলে গেল?’ নীরু তো কখনো এমন করত না। এমনকি মেয়েটির সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক, তাও বুঝতে পারলাম না।
পরের দিন নীরুদের বাড়ি গিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, সে ঘরের সামনে একটা ছবি হাতে বসে আছে। কেমন যেন লুকোচুরি খেলছে। আমি স্বাভাবিকভাবেই ঘরে ঢুকলাম।
"কীসের ছবি, নীরু?" আমি জানতে চাইলাম।
নীরু অপ্রস্তুত হয়ে ছবিটা লুকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আমি ততক্ষণে ছবিটা হাতে নিয়ে ফেলেছি—লীনার ছবি।
নীরু গম্ভীর হয়ে বলল, "এটা... তেমন কিছু না, সোহেল।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "কিন্তু এটা তো লীনার ছবি। কেন লুকোচ্ছিলি?"
নীরু চুপ করে রইল। ওর চোখে জল চিকচিক করছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই বুঝবি না, সোহেল। এটা এমন কিছু, যা তোর জানার বা বোঝার বাইরে।"
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আমরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেলাম। সেই মুহূর্তে আমি আর কিছু বললাম না, কিন্তু মনে মনে জানতাম, কিছু একটা গোপন করা হচ্ছে। কিন্তু কী? এই প্রশ্নটাই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
একদিন সকালে আবিদ আমাদের বাড়ি এল। খবর দিল, লীনা আর ওর পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
আবিদ বলল, "কিরে সোহেল, শুনেছিস? লীনারা চলে গেছে।"
আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, "কোথায়?"
আবিদ বলল, "ঠিক জানি না। সম্ভবত ভারতে। কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছে। সকালে গিয়ে দেখি, ওদের বাড়ি ফাঁকা।"
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আমি ধীরে ধীরে ঘরের দিকে গেলাম। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন আরও গভীর হলো—‘শেষ পর্যন্ত কী কারণে ওরা চলে গেল?’
পরে নীরু আমাকে জানাল, তাদের সম্পর্কটা আরও গভীর ছিল, আর লীনার সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসাই তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে সাহায্য করেছিল।
নীরু বলল, "আমরা দুজনেই জানতাম, কিছু একটা আছে, কিন্তু সত্যি বলতে, কেউ মুখ ফুটে বলতে পারিনি।"
লীনা প্রথমবার যখন নীরুর রেওয়াজ শুনেছিল, তখনই মুগ্ধ হয়েছিল। সেখান থেকেই তাদের সম্পর্কের শুরু। একসময় তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে।
একদিন, লীনা গোপনে নীরুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তখন এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত তৈরি হয়। লীনা বলে, "আজ আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব, দেবে?"
নীরু জানতে চায়, "কী?"
লীনা বলে, "তোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করার অনুমতি চাই।"
নীরু আবেগাপ্লুত হয়ে বলে, "এমন কথা বলিস না, লীনা। সময় বদলাবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তুই শুধু আমার হবি। আমাদের হৃদয়ের বাঁধন কেউ ছিঁড়তে পারবে না, কিছুতেই না।"
লীনা নীরবে প্রণাম করে চলে যায়। ওর চলে যাওয়ার পর নীরু যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা অনুভব করে।
নীরু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, "আর কখনো যেন ওকে হারাতে না হয়!"
এরপর নীরু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন এক নিশাচর পাখির কান্না অন্ধকারে ভেসে আসে। এই স্মৃতি বুকে ধরে নীরু জানে, তার জীবনে নতুন পথের সূচনা হবে।