ব্যস্ত জীবনের ঝড়ো দিনে হঠাৎ করেই প্রবীরের চোখ পড়লো পুরনো একটি কাঠের বাক্সের উপর। কাঠের বাক্সটি ধুলোর আস্তরণে ঢাকা, যেন নিজেকে সময়ের হাত থেকে লুকিয়ে গোপন করে রেখেছিলো। মনে হলো, এই বাক্সটি তার জীবনের এক অবিস্মৃত অধ্যায়, যা সময়ের কোলাহলে হারিয়ে গিয়েছিলো।
বাক্সটি খুলতেই এক আশ্চর্য রকমের অনুভূতি হলো আর বেরিয়ে এলো একটি ছোট্ট চামড়ার ডায়েরি। ডায়েরির পাশেই সুতো দিয়ে আঁকা ফুলের ডিজাইন সমৃদ্ধ একটি রুমাল। প্রবীরের দৃষ্টি আটকে গেলো সেই রুমালে। অচেনা কিন্তু চেনা অনুভূতিতে প্রবীরের মনে পড়ে গেলো সুতপা বৌদির কথা। তার মিষ্টি হাসি যেন এক অজানা সুর আর কণ্ঠে ছিলো সেই অদ্ভুত আবেদন- “এই নাও, আমার দেয়া ছোট্ট উপহার। নিজ হাতে বানানো রুমাল। সামান্য এক টুকরো স্মৃতি! অন্তত এটি দেখলে তো আমার কথা তোমার মনে পড়বে।"
প্রবীরের বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠলো। সময় যেন উল্টে যেতে শুরু করলো। সেই দিন বিদায়ের মুহূর্তে সুতপা তার হাতে তুলে দিয়েছিলো সেই রুমালটি। সুতো দিয়ে আঁকা প্রতিটি ফুল ছিলো যেন তার মনের কথা, কিছু না বলা অনুভূতি। রুমালের প্রতিটি ফুল যেনো সুতপার স্নিগ্ধতার প্রতীক, তার স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেনো এক অনবদ্য মুহূর্তের সাক্ষী। সেই শর্ষে ক্ষেতে হাঁটতে হাঁটতে সুতপার প্রকাশিত অনুভূতি, স্বপ্নের মতো সংবেদনশীল স্পর্শ, তার মিষ্টি হাসি, ঠোঁটের কোলাজে জমে থাকা না বলা কথা আর সেই মায়াবী চোখ যেন আবার প্রাণ পেলো।
স্মৃতির অতলে, যেখানে শুধু সে এবং সুতপা; এক নিষিদ্ধ কিন্তু অমোঘ ভালোবাসার চুম্বকীয় আকর্ষণ। সেখানে সময়ের বাঁধন হারিয়ে যায় আর স্মৃতি হয়ে ওঠে শ্বাসের মতো জীবিত, যা কখনো মরবে না, কখনো ম্লান হবে না।
প্রবীর রায় ঢাকায় একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে গ্রামের মাটির গন্ধ মাখা পরিবেশে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান প্রবীরের বাবা একজন ছোট ব্যবসায়ী, মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মা-বাবা এখনও গ্রামেই থাকেন, কিন্তু প্রবীর ঢাকার ব্যস্ত শহরের অচেনা ভিড়ে বন্ধুর সঙ্গে মেসে দিন কাটায়।
একদিন ছুটিতে বাড়ি গিয়ে শুনলো, পাশের গ্রামে একটি বিয়ের নিমন্ত্রণ এসেছে। মুকুল সরকার, প্রবীরের পিসতুতো দাদা; সেই দাদার শ্যালক মলিনের বিয়ে। মলিন, স্কুলজীবনে প্রবীরের সহপাঠী ছিলো; একই স্কুলে, একই ক্লাসে। সেই বন্ধুত্বের স্মৃতি তাকে অতীতে ফিরিয়ে নিলো।
মুকুল দাদার বিয়ের পর এ বাড়িতে আর আসা হয়নি প্রবীরের। তাই এই বিয়েতে এসেই প্রথম দেখা হলো তার মানে মুকুল দাদার স্ত্রী, সুতপার সঙ্গে। সুতপা যেন এক মায়াবী উপস্থিতি—ফর্সা গায়ের রঙ, দীর্ঘ তন্বী গড়ন, ঘন কালো চুল, কোমল ঠোঁটের মিষ্টি হাসি। তার চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গি—সব মিলিয়ে সুতপা যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতিমা।
এদিকে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো গ্রাম্য আচার-অনুষ্ঠানের চিরায়ত রূপে। বরযাত্রীদের সঙ্গে বিকেল বেলা বাসে উঠে শুরু হলো যাত্রা। বাস থামার পর গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হলো কিছুটা পথ। সন্ধ্যা নামার আগে বরযাত্রীরা পৌঁছালো কনে বাড়িতে। মৃদু শীতল বাতাস, কুয়াশা আর মাটির গন্ধে ভরপুর সেই সন্ধ্যায় প্রবীরের মনের কোণে স্মৃতির পর্দা নড়ে উঠলো।
রাতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চললো। ধীরে ধীরে কোলাহল স্তিমিত হয়ে এলো। অতিথিরা একে একে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। প্রবীরের মনে ছিলো এক ধরনের শূন্যতা। বহুদিন পরে গ্রামে ফিরে এসেও সবকিছু যেন অন্যরকম লাগছিলো- অচেনা, দূরের।
পরের দিন দুপুর বিয়েবাড়িতে সবাই সকালের খাবার খেয়ে কিছুটা অলস ভাবে সময় কাটাচ্ছে। বলতে গেলে কোলাহল অনেকটাই স্তিমিত। কারো যেন কোনো ব্যস্ততা নেই। মুকুল দাদা তার সাথীদের নিয়ে তাস খেলছে। প্রবীর তাদের পাশে বসেই সময় কাটাচ্ছিলো। এমন সময় সুতপা এসে তার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। গ্রাম্য পরিবেশে এমন অনাবিল সহজত্ব দেখে প্রবীর একটু বিস্মিত হলেও কিছু বললো না। বেশ কিছুটা সময় এভাবে কাটানোর পর সুতপা মুকুলদাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আমি প্রবীরকে নিয়ে শর্ষে ক্ষেতে যাচ্ছি। কিছু ছবি তুলবো।”
কথাটা শুনে মুকুল শুধু হেসে মাথা নাড়লো। সুতপা আর প্রবীর বাড়ির সামনের সরু পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো। গ্রামীন পরিবেশে শীতের দুপুরে আকাশে রঙের খেলা। চারপাশে শীতের নরম আলো আর হালকা কুয়াশা। সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুতপা হঠাৎ বললো, "তুমি জানো, ছোটবেলায় আমি তোমাকে কত দেখতাম? স্কুলে যাওয়ার সময়, কলেজে যাওয়ার সময়... তোমার সাইকেলের ঘণ্টার আওয়াজ শুনলেই জানালা দিয়ে উঁকি দিতাম।"
প্রবীর একটু থমকে দাঁড়ালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, "সত্যি! আমি তো কখনো জানতামই না! তুমি এভাবে দেখেছো আমাকে?"
সুতপা হেসে বললো, "জানবে কীভাবে? আমি তো দূর থেকেই দেখতাম। সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে তোমার প্রতি একটা অন্য রকম টান ছিলো। তুমি যখন কলেজে চলে গেলে, তখনও অপেক্ষা করতাম। ভাবতাম, একদিন হয়তো কথা বলার সাহস হবে।"
প্রবীর মৃদু হেসে বললো, "তোমার সাহস তো হলো না, কিন্তু আজ এত বছর পর এসে সব বলে দিলে!"
সুতপা থেমে গেলো। চারদিকে হলুদ গালিচার মতো শর্ষে ক্ষেত। সূর্যের আলোয় সেই ক্ষেত যেন আরও উজ্জ্বল। সে এক গভীর শ্বাস নিয়ে বললো, "জীবন তো বদলে গেছে প্রবীর। এখন বললে আর কী হবে? তবে তোমাকে এই সুন্দর জায়গায় নিয়ে আসতে পারলাম, এতেই শান্তি।"
প্রবীর সুতপার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। সুতপার চুলে বাতাস খেলা করছিলো। শাড়ির আঁচল শরীর ছুঁয়ে আকাশে ভাসছিলো। সে হাত দিয়ে শর্ষে ফুল ছুঁয়ে বললো, “তুমি জানো, এই রকম শর্ষে ক্ষেতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা আমার নেশার মতো। আজ তুমি আছো, তাই ভাবলাম তোমার হাতে কিছু ছবি তোলা থাকুক।”
প্রবীর ক্যামেরা বের করলো। সুতপা নানা ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। কখনো হাত উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো, কখনো শর্ষে ফুলের মধ্যে ঝুঁকে দাঁড়ালো। প্রবীর একের পর এক ছবি তুলছিলো; সুতপার অনাবিল হাসি আর মায়াময় দৃষ্টি তাকে সারাক্ষন মুগ্ধ করে রাখলো।
সুতপা কিছু না বলে শর্ষে ফুলের মাঝে হাঁটতে লাগলো। তার চোখের ভেতর যেন এক ধরনের চাপা দুঃখ। কিছুক্ষণ পরে সে দাঁড়িয়ে বললো, "জীবন অনেক অদ্ভুত, প্রবীর। তোমার প্রতি যে টানটা ছিলো, সেটা হয়তো একটা কচি বয়েসের অনুভূতি। কিন্তু এখন মনে হয়, সেটাই জীবনের একটা অমূল্য অধ্যায়।"
প্রবীর ধীরে বললো, "আমাদের জীবনের সব অধ্যায়ই মূল্যবান, সুতপা। কিন্তু সেগুলো যেন কখনো ভারী হয়ে না ওঠে।"
সুতপা হেসে বললো, "তুমি এখনও তেমনই রয়ে গেলে, সবকিছুকে হালকা করে নেওয়ার মানুষ।"
সুতপা ক্লান্ত হয়ে ক্ষেতের আলে বসে পড়লো। সেই বসা অবস্থাতেও প্রবীর আরো কয়েকটি ছবি তুললো। বিয়েবাড়ির কিছু কিছু হাঁকডাক দূর থেকে ভেসে আসছে। ঘড়িতে সময় দেখে প্রবীর বললো, “অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এবার ফেরা উচিত। বাসি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে নিশ্চয়ই। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বর-কনে সহ ফিরতে হবে”।
সুতপা বললো, "হুম, ঠিক বলেছো, এখনই খুঁজতে শুরু করবে; চলো ফেরা যাক। কিন্তু বড্ডো ক্লান্ত লাগছে। আমার হাত ধরে তোলো।"
প্রবীর হাত বাড়ালো। সুতপা তার হাত ধরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। তার নরম হাতের উষ্ণতায় প্রবীরের মনে হলো, শীতের মধ্যদুপুরেও যেন এক অদ্ভুত আগুন জ্বলছে। প্রবীরের মনে হলো, এই শর্ষে ক্ষেতে কাটানো মুহূর্ত, এই সংলাপ, এই হাত ধরা হয়তো তার জীবনের অনেক না বলা কথার সাক্ষী হয়ে থাকবে।
শর্ষে ক্ষেতের হলুদে মোড়া দিগন্ত যেন এক স্বপ্নপুরী। সুতপা বারবার তাকিয়ে দেখছিলো প্রবীরকে। ফিরতে ফিরতে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন দেখছো চারপাশ? শহরের ব্যস্ততা ছেড়ে এমন পরিবেশে আসতে কেমন লাগে তোমার?”
প্রবীর মৃদু হেসে বললো, “এই তো প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য। এতদিন পর এসে মনে হচ্ছে, সবকিছু যেন নতুন করে দেখছি।”
খুব গভীর আর মায়াবী কণ্ঠে সুতপা বললো, “এই প্রকৃতি যতই সুন্দর হোক, কিছু মানুষ এই সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি মায়াবী। জানো, প্রবীর? তোমার সাথে যদি জীবনের পথটা হাঁটতে পারতাম, আমার জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো।”
প্রবীর একটু চমকে গেলো। সে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু সুতপা তার চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বললো, “ভেবো না। আমি যা বলছি, তা শুধু অনুভূতির কথা। জীবনের বাস্তবতা কখনো এভাবে বদলায় না। কিন্তু অনুভূতিগুলো থেকে যায়।”
সেদিনের সেই শর্ষে ক্ষেতে কাটানো মুহূর্তগুলো প্রবীরের মনে যেন গেঁথে গেলো। সুতপার কথাগুলো, তার দৃষ্টি, তার হাসি—সবকিছুই প্রবীরের হৃদয়ে এক অতৃপ্ত স্মৃতি হয়ে রইলো।
প্রবীর বারান্দার এক কোণে বসে একটি উপন্যাসের পাতা ওল্টাচ্ছিলো। হিমেল বাতাসের শীতল স্পর্শ সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে। সুতপা এসে বললো, "বইটা নিয়ে আমার ঘরে বসে পড়ো। এখানে সবাই আসা-যাওয়া করছে, শান্তি পাবে না। তাছাড়া কনকনে শীতের বাতাস এসে লাগছে।”
প্রবীর বই নিয়ে তার পেছনে পেছনে গেলো। সুতপা তাকে ঘরে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো, "তুমি পড়ো, আমি কাজ করছি।"
কিছুক্ষণ পর ঘরে আবার ফিরে এলো সুতপা। দরজা বন্ধ করে দিলো। প্রবীর একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "দরজা বন্ধ করলে যে? কেউ দেখলে কি ভাববে?"
সুতপা রহস্যময় এক হাসি হাসলো। বললো, "তোমার ভয় পাচ্ছি নাকি! আমি তো এই ঘরেই থাকি।"
তারপর আলনার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি শাড়ি, ব্লাউজ আর পেটিকোট নামালো। প্রবীর বুঝতে পারছিলো না কী ঘটতে চলেছে। হঠাৎ সুতপা পরনের শাড়ি খুলে ফেললো। প্রবীর তড়িঘড়ি করে চোখ সরিয়ে নিলো।
"তুমি... এ কী করছো!" তার গলা কাঁপছিলো।
সুতপা মৃদু হেসে বললো, "চেঞ্জ করবো। তুমি এদিকে না তাকালেই হলো। আর তাকাতে চাইলে... কী আর বলবো!"
প্রবীর ড্রেসিং টেবিলের দিকে মুখ করে বসে পড়লো। কিন্তু আয়নার প্রতিফলনে সুতপার অনিন্দ্য সুন্দর পিঠ তার চোখে পড়লো। চোখ সরাতে চাইলেও সে সরাতে পারছিলো না।
সুতপা হাসিমুখে পেছন ফিরে তাকালো। "দেখো তো, লজ্জা লাগছে?"
প্রবীর তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কিন্তু তার মনে হচ্ছিলো, সুতপা যেন ভয়ংকর সুন্দর—তার সৌন্দর্য ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি করছে।
হঠাৎ সুতপার হাত থেকে ব্লাউজ মেঝেতে পড়ে গেলো। আয়নায় দেখে প্রবীরের মনে হলো সে ইচ্ছে করেই ব্লাউজটা হাত থেকে ফেলে দিলো। সুতপা পেছন ফিরে বললো, "প্রবীর, এদিকে এসো। ব্লাউজটা তুলে দাও তো। কোমরে একটু ব্যথা করেছে, নিচু হতে পারছি না।"
প্রবীরের মনে দোলাচল শুরু হলো। যাবে? নাকি যাবে না? কিন্তু তার পা যেন নিজের অজান্তেই এগিয়ে গেলো। ব্লাউজটা তুলে সুতপার হাতে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লো।
"আরেকটা অনুরোধ," সুতপা বললো। "পিঠটা একটু শুষ্ক লাগছে। ড্রেসিং টেবিল থেকে লোশনটা এনে মেখে দেবে?"
প্রবীর ধীরে ধীরে সুতপার দিকে তাকালো। তার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত নীরবতা। সুতপার চোখেও যেন এক ধরনের গভীরতা, যা প্রবীরকে আটকে ফেলছিলো। লোশন নিয়ে সে সুতপার পিঠে মেখে দিতে শুরু করলো। তার হাত যেন কাঁপছিলো। সুতপার শরীরের ঘ্রাণ আর কোমল ত্বকের স্পর্শে প্রবীরের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, তার সমস্ত আবেগ যেন এই মুহূর্তে উথলে উঠেছে।
সুতপা পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসলো। "তোমার হাত বেশ কোমল।"
প্রবীর কোনো কথা বললো না। সে দ্রুত ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরে গিয়ে চেয়ারটায় বসে পড়লো। তার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে তখন উত্তেজনা, কিন্তু মনের গভীরে ছিলো এক অদ্ভুত সংযম। প্রবীর বইটা হাতে তুলে নিলো। কিন্তু বইয়ের পাতায় তার চোখ স্থির হতে পারছিলো না। অক্ষরগুলো যেন অস্পষ্ট হয়ে একে একে মিলিয়ে যাচ্ছিলো তার মনের গভীরে তৈরি হওয়া অদ্ভুত আবেগের ঢেউয়ে।
সুতপা শাড়ি পরা শেষ করে মৃদু হাসিতে ঘরটাকে আলো করে তুললো। দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে এদিক-ওদিক দেখলো। তারপর আবার ফিরে এলো। ধীর পায়ে প্রবীরের পেছনে এসে দাঁড়ালো। তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, "আজকের এই মুহূর্তটা তুমি কি ভুলে যেতে পারবে?"
প্রবীরের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন বিদ্যুতের স্রোত বয়ে গেলো। সে শান্ত গলায় বললো, "না; আমি মনে হয় কোনো দিনই এই মুহূর্তের কথা ভুলতে পারবো না। এই দিনটি আমার মনে থাকবে। সারাজীবন মনে থাকবে।"
সুতপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ভুলভাবে তার মায়াময় দৃষ্টি প্রবীরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। প্রবীর একটু থেমে, তার চোখের গভীরে তাকিয়ে বললো, "তুমি কি জানো, তুমি কতটা অপরূপা? কতটা ভয়ংকর সুন্দর?"
সুতপার চোখের কোণ জলে ভিজে উঠলো। তার ঠোঁট কেঁপে উঠলো বিস্ময়ে। কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে মৃদু কণ্ঠে বললো, "হ্যাঁ, জানি। ছোটবেলা থেকে অনেকেই বলেছে আমাকে। কিন্তু... আজ তোমার মুখে এই কথাগুলো শুনে আমি যেন নতুন করে বুঝলাম। মনে হলো, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।"
তার কণ্ঠে তখন এক অদ্ভুত কম্পন। মুখে এক ধরনের আপ্লুত আনন্দ। সেই মুহূর্তে সুতপা যেন শুধু এক নারী নয়, এক অপরূপা দেবীর মতো মনে হলো প্রবীরের কাছে—অভিনব আর অতলস্পর্শী। প্রবীর একটু চুপ করে থেকে সরাসরি সুতপার দিকে তাকালো। তার চোখে এক অদ্ভুত বিষণ্নতা আর কৌতূহল। "তুমি আজ ইচ্ছে করেই এমন করছো, তাই না? কেনো করছো, বলো তো?"
সুতপা হাসিমুখে তার মাথার উপর হাত রাখলো। তারপর আবার কানের কাছে এসে মৃদু স্বরে বললো, "আমার কথা যেন তোমার সারাজীবন মনে থাকে। তুমি যেন আবার আমাকে দেখতে আসো।"
তার কথা শেষ হতে না হতেই সে হালকা করে প্রবীরের কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। তারপর গালের পাশ দিয়ে ধীরে সরে গেলো। প্রবীর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
সুতপা দ্রুত দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। প্রবীর চেয়ারে বসেই স্থির হয়ে রইলো। তার মনের ভেতর তখন যেন একটা ঝড় বইছে।
কিছুক্ষণ পর সুতপা আবার ঘরে ফিরে এলো, একেবারে স্বাভাবিক আচরণে। যেন কিছুই হয়নি। সে বললো, "তোমার দাদা খুব ভালো মানুষ। তাকে ভালোবেসে সংসার করছি। কিন্তু তোমার মতো এমন সুদর্শন, ব্যক্তিত্ববান আর রোমান্টিক মানুষ পেলে মনে হয় এ জীবন পরিপূর্ণ হতো! আর নিজের হৃদয় নিংড়ে সবটুকু ভালোবাসা আর মমতা উজাড় করে তাকেও পূর্ণ করে দিতাম। "
তার কণ্ঠে ছিলো এক বিষণ্ন হাসি। প্রবীর কিছু বলতে পারলো না। শুধু তাকিয়ে থাকলো সুতপার দিকে, যে নারীটি কিছুক্ষণের মধ্যে তার মনের ভেতর এক ভয়ংকর সুন্দর স্মৃতি গেঁথে দিয়েছে।
বিকেলে প্রবীর তার মাকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে সব শেষে সুতপার সামনে দাঁড়িয়ে সে বললো, "এবার আসি তাহলে।”
সুতো দিয়ে ফুল তোলা একটি রুমাল প্রবীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে সুতপা বললো, “এই নাও, আমার দেয়া ছোট্ট উপহার। নিজ হাতে বানানো রুমাল। সামান্য এক টুকরো স্মৃতি! অন্তত এটি দেখলে তো আমার কথা তোমার মনে পড়বে।"
প্রবীর উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “বাহ্! কি সুন্দর রুমাল! অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। শোনো, তোমার কথা আমার এমনিতেই মনে পড়বে। তবে এটি আমার জীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়েই থাকবে। তুমি ভালো থেকো।"
সুতপার চোখে-মুখে এক ধরনের বেদনার ছাপ ফুটে উঠলো। ভারী গলায়, নরম ও নিচু কণ্ঠে বললো, "তুমিও ভালো থেকো। আবার বেড়াতে এসো। আমাকে দেখে যেও। কি, আসবে তো?"
প্রবীর একটু থমকালো। তার মনে হলো, মাঝে মাঝে এসে সুতপা বৌদির সাথে দেখা করলে মন্দ হয় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনে ধাক্কা দিয়ে বললো, "না, এটা ঠিক হবে না। সে বিবাহিতা আর আমার পিসতুতো দাদার স্ত্রী। ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি এর কোনো পরিণতিও নেই—বরং এটি একটি সংসার ভাঙার কারণ হয়ে উঠবে।"
তবু, সুতপার মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সে অস্ফুট স্বরে বললো, "আসব।"
শব্দটি যেন তার নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো। প্রবীর কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ ফিরে তাকালো। পৃথিবীর সমস্ত মায়া যেন সুতপার চোখে জড়ো হয়েছে। তার সেই মায়া প্রবীরের চোখে এবং মনেও সঞ্চারিত হলো।
গাড়িতে উঠে প্রবীর দূর থেকে একবার শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখল। সুতপা তখনো দাঁড়িয়ে, প্রবীরের চলে যাওয়ার পথের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে আছে। তার এই চাহনি প্রবীরের হৃদয়ের গভীরে যেন এক অমোচনীয় দাগ কাটল। সেই মুহূর্তে প্রবীর বুঝতে পারল, এই অনুভূতি তাকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরবে।