Choose your product from the mega showcase from thousands of sellers
BD Trade Blogs
> Blogs > উপন্যাস > কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড-নোট

কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড-নোট


রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি চিঠি! যা ১২৭ বছর ধরে লুপ্ত ছিল! স্বয়ং ঠাকুর পরিবারের অধিপতি দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে ঠাকুর পরিবারের অন্দরের খবর ঢাকা পড়ে যায় এতোটা বছর ধরে! কিন্তু গূঢ় সত্যের প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী! সম্প্রতি সেই চিঠি ও চিঠির কথা উদ্ধার করা হয়েছে! যার আদ্যোপান্ত জুড়ে ছিল একটি নারীর গভীর আর্তি! তিনি ঠাকুর পরিবারের পুত্রবধূ কাদম্বরী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিনী, রবিঠাকুরের নতুনবৌঠান! চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্যে করে লেখা!

 

ঠাকুর পরিবারের উনিশ বছরের সুদর্শন যুবক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে বিয়ে হয় ন'বছরের কাদম্বরী দেবীর! কাদম্বরী দেবীর জন্মদিন ৫ই জুলাই! ঠিক জন্মদিনেই বিয়ে হয় কাদম্বরী দেবীর! রবিঠাকুরের বয়স তখন সবে সাত! আর যেদিন কাদম্বরী দেবী সুইসাইড করলেন তখন তার বয়স পঁচিশ আর রবিঠাকুরের তেইশ!

 

রবি ঠাকুর ছিলেন কাদম্বরী দেবীর ছেলেবেলার খেলার সাথী! বিয়ের পর থেকে একমাত্র রবিঠাকুরই ছিল তার চোখের মণি, প্রাণের ঠাকুরপো! ঠাকুর পরিবারের বৌ হিসেবে কাদম্বরী দেবীর যে সম্মানটুকু প্রাপ্ত ছিল তা তিনি তার জীবনকালে কখনো পাননি! তিনি মৃত্যুর পূর্বে রবিঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে এক সুদীর্ঘ চিঠি লিখে যান যা তার মৃত্যুর পর লোপাট করা হয়! সেই চিঠির প্রতিটি পাতায় উঠে এসেছে একজন নারীর চরম অসহায়ত্বের মর্মবাণী!

 

বিশাল ঠাকুর পরিবারে বিয়ে হওয়া স্বত্ত্বেও কাদম্বরী দেবী যে সকলের উপহাসের পাত্রী ছিলেন তা এই সুদীর্ঘ চিঠিটি পড়লে জানা যায়! একমাত্র রবিঠাকুরই ছিলেন কাদম্বরী দেবীর কাছের মানুষ, প্রাণপুরুষ, প্রাণের রবি, প্রাণের ঠাকুরপো! যার সাহচর্যে কাদম্বরী দেবী এক অনাবিল জীবন যাপন করে চলেছিলেন! যিনি রবিকে চোখের আড়াল করতে চাইতেন না কখনো! কিন্তু এই অনাবিল জীবনের ছেদ ঘটে রবিঠাকুরের বিয়ের কারণে! কাদম্বরী দেবী যা কখনো সহ্য করতে পারেননি! তিনি রবিকে হারাতে চাননি! রবিঠাকুরের বিয়ের চারমাস পরে কাদম্বরী দেবী নিজেকে চালিত করেন আত্মহনের সহজ পথে!

 

মৃত্যুর পূর্বে রবিঠাকুরকে লেখা কাদম্বরী দেবীর এই সুদীর্ঘ চিঠিতে উঠে এসেছে কাদম্বরী দেবীর পরিবারের গল্প; যারা ঠাকুর পরিবারের সাথে বংশগতভাবে জড়িয়ে আছে! কিন্তু ঠাকুর পরিবারের কাছে কাদম্বরী দেবীর পরিবার বরাবরই থেকে গেছে নিচুতে! যোগ্য সম্মান মেলেনি কখনো! কাদম্বরী দেবীর গরীব ঘরে জন্ম নেওয়ার বদৌলতে ও বংশসূত্রে তার পরিবার যে ঠাকুর পরিবারের ফরমায়েশ খেটে এসেছে চিরকাল তার জন্য সর্বদা সকলের কাছে করুণার পাত্রী হিসেবে যে অপমান সহ্য করেছেন তার বর্ণনা আসলে হৃদয়বিদারক! 

 

ঠাকুর পরিবারে গৃহিনী মহলে জ্ঞানদানন্দিনীর প্রবল প্রতাপ, স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যমনস্কতায় কাদম্বরী দেবী সর্বদা আশ্রয় খুজেছেন এবং সেই আশ্রয় পেয়েছেন প্রাণের প্রিয় রবির কাছে! বিয়ের পরে দাদা সত্যেন্দ্রনাথের ভবিষ্যতবাণী মর্মাহত করেছে কাদম্বরী দেবীকে! সন্তান না হওয়ায় সবার চোখে বাজা নারী হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন! চোখের সামনে বাবার অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছেন! এবং যখন রবিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন ঠিক তখনই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবল ইচ্ছে ও জ্ঞানদানন্দিনীর কুটকৌশলের কাছে হার মেনে রবির বিয়ে করা যা কাদম্বরী দেবীকে বেঁচে থাকার পথটা বন্দ করে দেয় চিরতরে! যার চরম পরিণতি হিসেবে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন!

 

কাদম্বরী দেবীর শেষ চিঠিতে উঠে এসেছে রবি ঠাকুরের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসার গল্প, প্রণয়ের গল্প! স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরম অবহেলা যা কাদম্বরী দেবী কখনো মেনে নিতে পারেননি! তিনি তাই অবলম্বন খুজেছেন রবির হৃদয়ে! তিনি মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছেন প্রাণের ঠাকুরপো রবিকে! জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জ্ঞানদানন্দিনীর সাহচর্যে উন্মুখ ঠিক তখন কাদম্বরী দেবী রবি ঠাকুরের প্রেরণাদাত্রীরূপে অধিষ্ঠিত! রবি ঠাকুরের লেখায় কাদম্বরী দেবীর পথচলা! রবির সব লেখায় কাদম্বরী দেবীর ছায়া প্রস্ফুটিত! রবির সব লেখার গুণমুগ্ধ শ্রোতা একমাত্র কাদম্বরী দেবী!

 

জ্ঞানদানন্দিনী সর্বদা কাদম্বরীকে বিভিন্ন অজুহাতে ঠেলে দিয়েছেন সবার থেকে দূরে! অন্দরমহলের সকল পরিচারিকার কাছে কাদম্বরী দেবীকে অসতী, অপয়া হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছেন!জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগ্য স্ত্রী হওয়ার পথে প্রধান বাঁধা হিসেবে সর্বাগ্রে জ্ঞানদানন্দিনী তার ছত্রছায়া বিরাজিত করেছেন! এমতাবস্হায় কাদম্বরী দেবী তার স্বামীর লেখা 'অলীকবাবু' নাটকের হেমাঙ্গিনী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে রবি ঠাকুরকে তার ভালোবাসার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেছেন সবার সম্মুখে! সেটা নিছক অভিনয় নয়, ছিল রবি ঠাকুরের প্রতি তার ভালোবাসার আপ্তবাক্য! তিনি রবি ঠাকুরের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করলেন তার স্বামীর লেখা লাইনগুলি!

"আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করিয়ে, মুক্তকণ্ঠে বলিব, লক্ষবার বলিব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলিব, সহস্রবার বলিব, লক্ষবার বলিব, আমি তোমার স্ত্রী৷"

 

একটু একটু করে কাদম্বরী দেবী রবি ঠাকুরের প্রতি যে আস্হার জায়গা তৈরি করেছিলেন তা এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায় রবির বিয়ের খবরে ও রবির লেখা কিছু কবিতার অক্ষরে! বিয়ের পরে কাদম্বরী দেবীর প্রতি রবি ঠাকুরের অবহেলা আত্মহত্যার পথকে আরো প্রশস্ত করে! রবি লেখেন এক অমোঘ কবিতা, যা কাদম্বরী দেবীকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দেয়! রবি লেখেন, 

"হেথা হতে যাও পুরাতন৷

হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে!"

 

কাদম্বরী দেবী সারাজীবন রবিকে হারানোর ভয়ে থেকেছেন, আর ঠিক যখন রবির বিয়ে সম্পন্ন হলো তখন তো আর তার হারানোর কোন কিছু অবশিষ্ট রইলো না! তিনি চিরকালের জন্য হারালেন রবির সাহচর্য, ভালোবাসা! 

 

যে চিঠির শুরু হয়েছিল ভালোবাসার আর্দ্র অনুভূতি, বেদনার বহিঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে, 'প্রাণের রবি' শব্দের মাধ্যেমে সে চিঠির শেষেও ছিল ভালোবাসা, চিরকালের মতো হারানোর বেদনা, শব্দমালার অমোঘ বন্ধন!

 

'আমাকে মনে রেখো রবি', এ-কথাটুকু বলার স্পর্ধাও আমার নেই৷ আমার সব গেছে গো সব গেছে৷

রবি- শুধু ভালোবাসাটুকু যায়নি৷ আজও তোমাকে খুব ভালোবাসি৷ এইটুকু বিশ্বাস কোরো৷

       তোমার নতুনবৌঠান

 

১৮৮৪ সালের ১৯শে এপ্রিল কাদম্বরী দেবী আফিম খেলেন আত্মহত্যার নিমিত্ত! মারা গিয়েছিলেন ঠিক দুদিন পর ২১শে এপ্রিল! মারা যাবার ঠিক ১২৭ বছর পর উদ্ধার করা হয় জীর্ণ, শীর্ণ, আগুনে ঝলসে যাওয়া মৃত্যুর পূর্বে রবি ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে লেখা সুদীর্ঘ চিঠি! যার পরতে পরতে লিপিবদ্ধ আছে একজন নারীর হাহাকার, একটুকু ভালোবাসার ক্ষেদ, অবলম্বন হয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ!


সাহিত্য >> উপন্যাস