‘সম্পর্ক’ শব্দটি আমাদের সমাজে চলার পথে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্পর্ক এমন একটি শব্দ যেখানে লুকিয়ে আছে হাজারো অর্থ। এই শব্দটির সঙ্গে মিশে আছে মায়া, টান, ভালোবাসা, আন্তরিকতা। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ‘সম্পর্ক’ নামের শব্দটি। আঁকড়ে ধরে রাখার যে মায়ার বন্ধন ‘সম্পর্ক’ সেখানে ভাঙনের পাল্লা যেন ভারী হচ্ছে সেই শব্দটির সঙ্গে।
আমরা যে সম্পর্কে আবদ্ধ, সেখানে প্রথমেই জেনেটিক্যালি চলে আসে বাবা-মা, ভাই-বোন ও পরিবারের কথা। আর এর বাইরে যে পৃথিবী আছে সেখানে কখন, কীভাবে কোথায় মনের অনুভূতির এক গুচ্ছ মিলনে আরেকটি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, আমরা জানি না। সেই সম্পর্ক হতে পারে দুজন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব, তারপর সেই বন্ধুত্ব থেকে রূপ নেয় ভালোবাসায়। কিন্তু কখন সেই বন্ধুত্ব অথবা ভালোবাসায় ফাটল ধরবে কেউ জানে না।
সম্পর্কের কত প্রকার ভেদ আছে তার সংজ্ঞা অনেকেরই জানা নেই। বর্তমান সমাজে কিছু সম্পর্ক নিয়ে এই সম্পর্কের ফাটল নিয়ে আজকের কিছু লেখা।
আমরা সম্পর্ক ছাড়া কখনো চলতে পারব না। কিন্তু সম্পর্ক গড়ে তোলার আগে আমরা অনেক কিছু যাচাই–বাছাই করি না। অনেক সময় একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই অন্য একজন মানুষকে সবকিছু বলে ফেলি। যে ভুলটি অনেকের জীবনে অসংখ্যবার হয়েছে। আর এ কারণেই সেই মানুষটি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষতিও করেছে।
আমরা অনেক সময় আমাদের আপনজন, যেমন খুব কাছের মানুষকে কোনো একটি বিষয় শেয়ার করছি না। কিন্তু সেই আপনজনের সম্পর্কের বাইরে গিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলছি। হয়তো সেই সম্পর্কের চেয়ে বাইরের মানুষকে আরও বিশ্বাসী মনে হয়। আবার যে সমস্যার সমাধান পরিবার করতে পারবে না, সেই কাজটি অন্য একজনকে দিয়ে হবে বিধায় আমরা নতুন সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছি।
আজকাল সম্পর্কটি যেন হয়ে গেছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’। বিষয়টি এ রকম, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সম্পর্ক যেন খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। মানুষের মধ্যে যে আন্তরিকতার অভাব, তা এখন স্পষ্ট। সত্যিকার অর্থে এই ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ সম্পর্কটি বেশ কিছুদিন আগেও এত ছিল না।
একটি সম্পর্ক গড়তে গেলে যেসব গুণ থাকে সেগুলো হলো সততা, ওয়াদা, বিশ্বস্ততা, বন্ধুত্ব, দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা, বোঝার ক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও ভালোবাসা। কিন্তু এসব গুণ আজ ঘুণে ধরেছে বলে সম্পর্ক হয়ে গেছে সেই ‘গিভ অ্যান্ড টেক’। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বচ্ছতা, বোঝার ক্ষমতা অথবা দায়িত্বে অবহেলার কারণে আজ সম্পর্কে ফাটল। বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, সন্তান হয়ে যাচ্ছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হচ্ছে বিচ্ছেদ, বন্ধুত্বের মধ্যে থাকছে না সততা অথবা ওয়াদা পালনের ক্ষমতা।
উঠতি বয়সের একটি বড় অংশ মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আনলিমিটেড সময় পর্যন্ত খেলা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেলে কিংবা মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করা, সারা রাত মোবাইলে চ্যাট করা, ভিডিও দেখা ও গেম খেলা ছাড়াও রয়েছে দিনের যেকোনো সময়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। হোমওয়ার্কের নামে ল্যাপটপ নিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকা, বাবা কিংবা মা সামনে থাকলে তাদের সামনে লেখাপড়ার ব্যস্ততার ভাব দেখানো ছাড়াও তাদের সন্তুষ্ট করতে বেশি সময় ধরে লেখাপড়া করছে এরকম ভাব দেখানো। বাবা-মা কিংবা পরিবারের অভিভাবক সামনে থেকে চলে গেলেই আবার ভিডিও দেখায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। এ রকমভাবে লেখাপড়ায় দিনে দিনে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। ফলে তারা স্কুলে ভালো গ্রেড করতে পারছে না। এসব সমস্যার কারণে পরিবারের চিন্তার শেষ নেই।
মা ও বাবা মিলে যদি সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করেন আর সেই কাজটি যদি একটি পরিবারে সন্তানদের জন্য ঠিকঠাক করা হয়, তবে সম্পর্ক ও আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে কোনো কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে দিলে দায়িত্ব শেষ নয়। কোচিং, প্রাইভেট টিউটর রেখে লাখ টাকা খরচ করলেই সবকিছু ভালো চলেছে—এমন ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। সন্তানদের নিয়ে বাইরে যাওয়া, তাদের কথা শোনা, তাদের কী বলার আছে সেই স্বচ্ছতার জায়গা ঠিক রাখতে বেশি কিছু করতেও হয় না।
ঠিক তেমনি বিয়ের বিষয়টি। আমাদের দেশে সংসারে অশান্তি, ডিভোর্স, সন্দেহ এক মহামারি আকার ধারণ করেছে। দুটি মানুষের পরস্পরের ভালো লাগা, ভালোবাসার সম্পর্ককে যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য বিয়ে করা হয়, যে দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে সংসার শুরু করে, একটা সময় সেই একজন অন্যজনের প্রতি একটি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নিজেদের দায়িত্ব থেকে সরে পড়ে। অতঃপর সেই সম্পর্কে ফাটল ধরে ডিভোর্সে গড়ায়। আর পেছনে অনেক কারণ আছে। আমরা এখন ভালোবাসা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বোঝার ক্ষমতা, দায়িত্ববোধ সবকিছু যেন হারিয়ে ফেলেছি।
তাই একটি সংসার গড়ার আগে সেই জায়গায় স্বচ্ছতা রাখা খুবই জরুরি। ভেবেচিন্তে জীবন সঙ্গী করাই শ্রেয়। কারণ সম্পর্ক তৈরি করা খুব সহজ, কিন্তু ধরে রাখা খুবই কঠিন। তবে সেই জায়গায় ওপরের বিষয়গুলো ধরে রাখলে সুসম্পর্ক গড়ে তোলাও সহজ।
সবশেষে বলা যায়, সম্পর্ক এমন একটি উপলব্ধির নাম, সেটি সময়ের বিবর্তনে খারাপ হয় গেলেও রেশ থেকে যায়। আর একটি সুসম্পর্ক নিয়ে জীবনের মুহূর্তগুলোকেও সুন্দর করে তোলে। তাই প্রাণবন্ত হয়ে বাঁচতে গেলে সুসম্পর্কটা খুবই জরুরি।