স্বপ্ন কখনও কখনও সত্যি হয় বলেই দুঃস্বপ্ন দেখলে মনটা ছটফট করতে থাকে অনাকাঙ্খিত কোনো অমঙ্গলের আশঙ্কায়। তবে আমার শাশুড়ী একটা গাছ নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে অমঙ্গলের কথা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন শুনে প্রথমে হাসি পাচ্ছিল, তবে একটু পরেই তার শঙ্কিত হবার কারণ বুঝলাম।
আমাদের বাড়িটা আশ-পাশের বাড়িগুলো থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। দক্ষিণ দিক খোলা, ঢোকার পথেই বৃহদাকার ইউক্যালিপ্টাস। কয়েক একর জমি পেরলেই ধলেশ্বরী নদী। এপারে এলাসিন ঘাট আর ওপারে নলসন্ধ্যা। দূর থেকে দখিনা হাওয়া ধলেশ্বরীর বুকে শিহরণ জাগিয়ে ইউক্যালিপ্টাসের পাতাগুলোকে দোলা দিয়ে ছুটে আসে বাড়ির ভেতর। শ্বশুড়ীর দুঃস্বপ্নটা এই ইউক্যালিপ্টাসকে নিয়ে; স্বপ্নে দেখেছেন গাছটি মরে গেছে, আর সে নিয়েই তার শঙ্কা।
পল্লী বিদ্যুতের কল্যানে আমাদের গৃহে বিজলী আছে। কিন্তু তার উধাও হয়ে যাওয়া বা ফিরে আসাটা কোনো রুটিন মেনে চলে না। বস্তুত তার কোনো সময় জ্ঞান নেই। জ্যৈষ্ঠের তপ্ত দুপুরে যখন আমাদের কোন কাজ থাকে না, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একটু আরাম করে দিবানিদ্রায় যাবার ইচ্ছায় শরীরটা অলস হয়ে পড়ে তখনও তার নিখোঁজ হয়ে যেতে একটু বাঁধে না। সেদিনও খাওয়ার পরে বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরে থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়ল; দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। শাশুড়ী আবার সেই ইউক্যালিপ্টাসকে নিয়ে তার দুঃস্বপ্নের কথা বললেন। তার একটাই প্রশ্ন, এমন খারাপ স্বপ্ন তিনি কেন দেখলেন ! দীপুর যদি কিছু হয়! দীপুর যেদিন জন্ম হয় সেদিন আমার শ্বশুড় এই ইউক্যালিপ্টাসটি লাগিয়েছিলেন। যদিও দীপুর জন্মকে স্মরনীয় করে রাখতে নয় বরং বিষয়টি কাকতালীয়; তবু শাশুড়ীর ধারনা, গাছটির সাথে দীপুর একটা সম্পর্ক আছে। এর আগে একবার এ গাছ নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখার পর দীপুর শরীর খারাপ করেছিল। সেই থেকে তার ধারণা আরও গভীর হয়েছে।
দীপুর কারণেই ওর বৌদির আসনটি দখল করে এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ওর সাথে পরিচয়; সে ছিল আমার এক ইয়ার নিচে এবং আলাদা বিভাগে। এক সাহিত্য বাসরে আমার লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করেছিল সে। অনুষ্ঠান শেষে আমি ডেকে পরিচিত হয়েছিলাম ওর সাথে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। বন্ধুত্ব হবার পরই ওর বৌদি বানাবে বলে সংকল্প করল; আমারও আপত্তি ছিল না। দীপু যে পরিবারের ছেলে, সে পরিবারের বউ হয়ে আমি সুখী হব বলেই ধারনা হয়েছিল। শ্বশুড় ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা; যেমন তার ব্যক্তিত্ব, তেমনই তার খ্যাতি; শাশুড়ী উদার মনের। তারা দুজনেই আমাকে নিজের মেয়ের মত øেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন। পাছে আমার পতিভাগ্যে কেউ হিংসে করে বসেন, তাই তাকে নিয়ে বেশি বলতে ইচ্ছে করি না। মূলতঃ এ বাড়িতে আমি কোনো কিছুরই অভাব বোধ করি না।
যে দীপুর জন্য এ বাড়িতে বউ হয়ে এলাম, যে আমার এতখানি আপনার জন, তার জন্য উৎক›িঠত মাকে সান্তনা দিলাম ঠিকই, কিন্তু নিজের মধ্যেও এক অজানা উদ্বেগ দেখা দিলো ! পরের দিনই দীপু বাড়িতে এলো। সাধারণতঃ দীপু রিক্সা নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আসে না; এলাসিন ঘাট থেকে চার-পাঁচ মিনিটের পথ পায়ে হেঁটেই চলে আসে। কিন্তু এবার রিক্সায় আসছে দেখেই বুকটা কেঁপে উঠল ! মনে হল, সন্তানের অমঙ্গলের আভাস মায়ের মনে সত্যি আগেই ধরা পড়ে। দীপু আক্রান্ত হয়েছে জন্ডিসে। সাড়ে তিন বছর আগে একবার জন্ডিস হয়েছিল; তখন অবশ্য ১৫ দিনের বিশ্রামেই সুস্থ হয়েছিল। এবার ডাক্তার বলে দিয়েছেন, টানা দেড় মাস পূর্ন বিশ্রাম। রক্ত স্বল্পতার কারণে শরীরটা খুবই র্দুবল; কখনও কখনও পেটে ব্যথায় কষ্ট হত। কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে দিত না। মা-বাবার অবস্থা ভেবেই কষ্টের কথা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করত। আমি বুঝতে পেরে একদিন বললাম, আমার কাছে কিছু আড়াল করতে চেও না দীপু। প্রয়োজন হলেই ডাকবে, আমি সব দিক ম্যানেজ করে নেব। কথাটা বলে আমি একটু হাসলাম, দীপুও হাসল-স্বস্তির হাসি !
দীপুর অবস্থা যে দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে, এক সময় সবার চোখেই ধরা পড়ল। সারা শরীর গাঢ় হলুদ বর্ণ ধারন করাতে ভাবনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে রীতিমত ঘাবড়ে যেতে হল। বিলিরুবিন অনেক বেড়ে গেছে। সেদিনই নিয়ে যাওয়া হল ঢাকাতে, দেখানো হল একজন লিভার স্পেশালিষ্টকে। পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর তিনি জানালেন, সবই এখনও নিয়ন্ত্রনে আছে; আর বৃদ্ধি পাবার কথা নয়। তবে একবার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে কারও আর কিছু করার থাকবে না। হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেন। কিন্তু দীপু হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজী হল না কিছতেই; বলল, আর ক’টা দিন দেখা যাক না। প্রয়োজনে সপ্তাহ খানেক পরে না হয়...। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের এক প্রতিবেশি একজন কবিরাজের কথা বললেন; তার কথা আমরা আগেও অবশ্য শুনেছি। কিন্তু এতটা আশঙ্কাজনক অবস্থায় তার উপর নির্ভর করার সাহস কারও হয় না। তবূ সবার পরামর্শে কবিরাজকে নিয়ে আসা হল। ঔষধ দিলেন তিনি। প্রতিদিন পাঁচবার খেতে হয় পাঁচ রকমের ঔষধের বড়ি কাঁচা পেঁপে রস, অড়হড়, শেফালি, ক্ষেতপাপড়া আমগুরুজের পাতা বা কাণ্ডের রসের সাথে। চার দিন খেতেই উপকার বোঝা গেল, সাত দিন পরে রক্ত পরীক্ষায়ও প্রমান পাওয়া গেল কমেছে কিছুটা। আরও এক মাস ঔষধ খাওয়ানো পর চমৎকার ফল পাওয়া গেল, বিলিরুবিন কমে গেল অনেক টুকু; সবার মনে আশা জেগে উঠল! তারপর শ্রাবণ এলো। শুরু হল অঝর ধারায় বর্ষণ। দিনের সূর্যকে ঢেকে দিয়ে, রাতের চাঁদ-তারাকে আড়াল করে অবিরাম চলতে থাকল শ্রাবণের অশ্রু বরষণ। নদীর দু’কুল ছাপিয়ে ফুলে উঠল বর্ষার জল। উঠে এলো বাড়ির আঙিনায়। তবু থামবার কোন লক্ষণ নেই। জল কেবল বাড়ছে আর বাড়ছেই। মনে হয়, আমাদের অনাচার আর পাপাচারের আবর্জনা বছরের পর বছর ধরে জমাট হয়ে আছে বাংলা মায়ের বুকে। সেই আবর্জনার ভার আর যেন সইতে পারছে না বঙ্গজননী। তাই আবাহন করেছেন গঙ্গাঁদেবীকে, অফুরন্ত জল দিয়ে সে আবর্জনা ধুয়ে নেবার জন্য।
গঙ্গাদেবী সারা বাংলা জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন তবু যেন জুড়ায় না তার বুকের জ্বালা, আবর্জনা হয় না পরিষ্কার, মিটে না জলের পিয়াস ! এদিকে তার সন্তানেদের সন্তরণের ক্ষমতা লুপ্ত প্রায়, তাদের ঠিকানা বাংলার বুক থেকে মুছে হতে চলেছে ঐ গঙ্গাঁবক্ষেই, সে খেয়াল নেই; আরও জল চাই তার। চারদিকে অথৈ জল, সারা দেশ ডুবে আছে জলের নিচে; ঘরের মেঝেতে জল। তিন চারটে করে ইট দিয়ে খাটকে জাগিয়ে রেখে কোন রকমে থাকতে হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বোধ করি বন্যার নতুন রেকর্ড হতে চলেছে। জল এক সময় কমতে শুরু করল। ঘর থেকে জল নেমে গেলে একদিন দেখি, দীপু অনেকক্ষণ ধরে একটা ছবি দেখছে। আমি কাছে গেলাম; দীপু জানালার ধারে বসে থখন বাইরে তাকিয়ে; ছবিটা বিছানার উপর। ছবিতে ওরা তিন বন্ধু। মাঝখানে দীপু, দুপাশে দু’বন্ধু। ছবিটা হাতে নিয়ে বললাম, কি ব্যাপার দীপু অনেক সময় ধরে এ ছবি নিয়ে বসে আছো যে ! ওদের কথা মনে পড়ছে বুঝি ?
জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “ভেবেছিলাম ছবিটা বাঁধাই করে ঘরে টাঙিয়ে রাখব, নিচে লেখা থাকবে: দ’ুপাশের দুজন আজ আর নেই। কিন্তু করি-করি করে আর করা হল না; হয়ত অদৃষ্টই আমাকে করতে দেয়নি। বৌদি, যদি এ যাত্রায় আমি সেরে না উঠি, ওদের মতই চলে যাই আমিও তাহলে ছবিটা তুমি বাঁধিয়ে রেখে দিও আমার ঘরটাতে। আর নিচে লিখে দিও- ওরা কেউই আর বেঁচে নেই এই সুন্দর পৃথিবীতে”।
দীপু একটু হাসার চেষ্টা করল। আমি ধমকের স্বরে বললাম, এমন খারাপ কথা ভাবছ্ধোসঢ়; কেন আজ তুমি? তুমি এখন অনেকটা ভালো, বন্যার কারনে একটু সমস্যা হচেছ; জল নেমে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি না খুব শক্ত মনের মানুষ ! তবে আজ কেন তোমার সাহস হারিয়ে ফেলছ তুমি?
দীপু খুব গম্ভীর ভাবে বলল, “সবকিছু বোধ হয় সাহস আর শক্তি দিয়ে জয় করা যায় না, বৌদি। আর এ জন্যই ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে হয়- যিনি আমাদের অলক্ষ্যে বসে ঘুরাচেছন ভাগ্যের চাকা”। একটু থেমে কোল থেকে বলিশটা টেনে পিঠের দিকে দিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আবার বলল, “একটা গল্প শুনবে তুমি ? গল্পটা অবশ্য আমারই, আমাকে নিয়েই। গল্পটা একটু বড়, তুমি বিরক্ত হবে না তো”?
আমি অভয় দিলাম। দীপু বলতে শুরু করল, “হঠাৎ করেই যমরাজের দৃষ্টি এসে পড়ল আমার উপর, এক যমদূতের উপর হুমুক হল, আমাকে তার দরকারে হাজির করবার। যমদূত রাজার আদেশ পালনের নিমিত্তে ছুটে এলো আমার কাছে; হেপাটাইটিসের ভাইরাস হয়ে আমার রক্তের মধ্যে ঢুকে শুরু করল অক্রমন। যখন বুঝতে পারলাম তখনই গেলাম ডাক্তারের কাছে। যমদূতকে হঠানোর সব কৌশল শিখে এলাম। কিন্তু এলোপ্যাথি পদ্ধতিকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা সে আগেই নিয়ে এসেছিল; তাই সে নির্বিঘ্নে আক্রমন চালাতে লাগল। সেই মুহূর্তে এগিয়ে এলেন এক বিজ্ঞ কবিরাজ; পরীক্ষামূলক ভাবে তার পদ্ধতির কার্যকারিতা দেখার জন্য হাসপাতালে ভর্তি কিংবা বিদেশে যাওয়াটা স্থগিত করা হল। বোধ করি, যমদূত হাসপাতালের ঝক্কি বা দেশের বাইরে যাবার লম্বা পথের ধকল সহ্য করতে ইচছুক ছিল না সে সময়ে। তাই আক্রমন শিথিল করল কিছুটা। কবিরাজ তার ৩৬ বছরের চিকিৎসা জীবনে মানুষের রক্তের সাথে জন্ডিসের প্রেমকে টিকতে দেননি কোন কালেই। তিনি অব্যর্থ ভাবেই জন্ডিসের প্রেমে বিচেছদ ঘটিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন একেবারে নিরাপদ দূরত্বে। আমার ক্ষেত্রেও কবিরাজের ক্ষেপনাস্ত্র ঘায়েল করে দিল যমদূতকে। কিন্ত পরাস্ত হয়ে, রাজ-আজ্ঞা পালনে ব্যর্থ হয়ে কি করে সে ফিরে যাবে যমদরবারে ! তাই মরন কামড় দিল; শুরু করল গেরিলা আক্রমন, অনেকটা কাপুরুষের মত। সে ঠিকই চিনেছিল কবিরাজের দুর্বল জায়গাটা। ঔষধের উপাদানগুলো ডুবিয়ে মারল বন্যার জলে।
তোমাদের এত এত সেবা-শশ্রƒষা, আদর-যত্ন, øেহ-মায়া আর মঙ্গল কামনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে যমদূত হয়ত রাজার হুকুম তামিল করে ফিরে যাবে বীরদর্পে”। দীপু শেষ করতেই বলে উঠলাম, গল্পটা কি উল্টোভাবে হতে পারে না? দীপু এবার একটু ম্লান হাসি হাসল, বলল, “হ্যাঁ, তাও হতে পারে; আর তা যদি হয়ই তবে সে কেবল সম্ভব হবে মা-বাবার আর তোমাদের অধৈর্য্য চিত্তে সেবা-শুশ্রƒষা, পরিচর্যা ও ভালবাসা, আত্মীয় পরিজনদের উদ্বিগ্ন চিত্তে সুস্থতা প্রার্থনার ফলে”।
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, তুমি অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠবে। আর এলোমেলো ভেবো নাতো। বন্যার জল নেমে যাক; তারপর রক্ত পরীক্ষা করে দেখবে...।
দীপু আপন মনেই বলল, “বন্যার জলই যত সমস্যা বাঁধাল। ভেসে বেড়াচ্ছি জীবন ও মৃত্যুর মোহনায়। এক দিকে জীবনের আলো ঝলমলে সুন্দর দিন আর অন্য দিকে মরনের ভয়াল অন্ধকার অমাবস্যা রাত। বন্যার জল চলে গেলেই হয়ে যাবে চূড়ান্ত মীমাংসা। জীবন কিংবা মৃত্যু। জীবন কি ক্রমেই দুরে সরে যাচ্ছে ? মৃত্যু পায়ে পায়ে কি এগিয়ে আসছে আমার দিকে?”
বুঝলাম দীপুর মন আজ ডুবে আছে ভাবনার গভীরে। আমি বললাম, এত ভাবনার কাজ নেই তোমার; খুব হয়েছে। চূড়ান্ত মীমাংসায় তোমারই জয় হবে; ঐ যমদূতের ব্যাটার কোন খবরই থাকবে না।
স্মরণকালের ভয়াবহতম দীর্ঘস্থায়ী বন্যার জল কিছুদিন পরেই ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটিয়ে নেমে গেল নিচে। মানুষের জীবন কেড়ে, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট আর ফসলের বিস্তর ক্ষতি ঘটিয়ে বন্যার জল চলে গেল দীপুর ওষুধের গাছগুলো নিশ্চিহ্ন করে। দীপুর শরীর আবার হলুদ হতে শুরু করল। হাতে পায়ে একটু জলও এল। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে সবাই আবার নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কবিরাজ এসে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে ফিরে গেলেন। সিদ্ধান্ত হল কলকাতা নিয়ে যাবার। যাবতীয় ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। দীপু আপত্তি করে বলেছিল, “ওখানে গেলেও আমি আর ভাল হব না, বরং মরেও কষ্ট পাব। বাড়িতে বসে মরলে অন্তত একটু সুখে মরতে পারব”।
আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। দীপু চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে খুব নিচু গলায় বলল, “তোমাকে হয়ত আগেও বলেছি, আমি খুব সুখী মানুষ। সত্যি খুব সুখী ছিলাম, বৌদি। আমার চাহিদা ছিল অল্প, আশা ছিল ছোট, হয়তবা সে কারনেই যখন যেটুকু চেয়েছি ঈশ্বরের কাছে সেটুকু পেয়ে গেছি। কিন্তু নিজের জীবন প্রার্থনা করার সাহস হয় না। সুখী মানুষদের জীবন বুঝি এমন অল্প দিনেরই হয়”!
দীপু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, দোহাই লাগে দীপু, আজ আর কোন খারাপ কথা বলো না। দীপু ধীরে ধীরে বলল, “ঠিক আছে, আর বলব না। মাঝে মাঝে কি যে হয়, কেবল খারাপ ভাবনা এসে ভীড় করে মাথায়। তবুও সম্ভবপরের জন্য প্রস্তুত থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই তোমার জন্য কিছু কাজ রেখে যাব। ধর, যদি খারাপ কিছু ঘটেই যায়, আমি আর ফিরে না আসি, তাহলে এই ড্রয়ারের মাঝে একটা চিকন নোটবুক পাবে। সেটাতে আমার ব্যাংক একাউন্ট সহ আরো কিছু তথ্য পাবে। কিছু অসমাপ্ত কাজের কথা জানতে পারবে; খুবই সাধারণ কাজ, তোমার পক্ষে শেষ করা সম্ভব। ড্রয়ারের চাবিটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। তবে শেষ পর্যন্ত না দেখে ড্রয়ার খুলবে না কিন্তু; কিছুতেই না”।
দীপরু মুখে হাসি দেখে মনে হল, এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবার আগে নিজের মনের সাথে একবার বোঝাপড়া করে নিজেকে তৈরি করল, মনকে দৃঢ করে নিল।
সেদিন হঠাৎ করেই শ্রাবন্তী এলো। বছর খানেক আগে ওই পাড়ায় রিমি বৌদির ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল রিমি বৌদির মামাতো বোন শ্রাবন্তীর সাথে। সে-ও দীপুর মত জীবনকে দেখে গভীর ভাবে। শ্রাবন্তীর সাথে পরবর্তীতে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দেখা খুব একটা হয় না; ফোনে কথা হয় নিয়মিত। অসুস্থ দীপুকে দেখার জন্য ছটফট করেছে কিন্তু দ্বিধা আর সংকোচ যেন কিছুতেই দূর হয় না। অবশেষে রিমি বৌদির বাসাতে আসার নাম করে চলে এলো। আমাদের বাড়িতে যখন পৌছুল তখন পৃথিবীর বুক থেকে রৌদ্রের রঙ মুছে গিয়ে সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে।
শ্রাবন্তীর সাথে দীপুর কথা শুরু হল হাসি-খুশির মধ্য দিয়েই। কিন্তু শেষের দিকে আলাপের গতিটা বয়ে গেল ভিন্ন ধারায। দীপুকে বিষন্ন মনে হল। উদাসী ভাবে বলল, “জীবনটা খুব সুন্দর আর মায়াবী। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখতে পাচ্ছি শ্রাবন্তী। মৃত্যুকে যত বেশি কাছে থেকে দেখছি জীবনের প্রতি মায়াও বেড়ে যাচ্ছে তত বেশি। জীবনের উপর হয়ত অনেক অবহেলা করেছি, তাই জীবন তার শোধ নিয়ে নিল। কিন্তু আজ বেঁচে থাকার জন্য বড় বেশি লোভ হচ্ছে আমার”।
শ্রাবন্তী সান্ত্বনার কন্ঠে বলল, “তুমি বেঁচে থাকবে। অবশ্যই বেঁচে থাকবে, দীপু।
দীপু আগের মতই আবেগ জড়ানো গলায় বলল, “আজ আমারও খুব সাধ হচ্ছে বেঁচে থাকতে, এই সুন্দরের মাঝে, নিত্যদিনের এই কান্না হাসির মাঝে, আনন্দ বেদনার মাঝে”।
দীপুর চোখে জল এসে পড়ল, শ্রাবন্তীর চোখ ভিজেছে আরও আগেই। শ্রাবন্তী নিজের চোখ মুছে দীপুকে বলল, “আমি তোমার চোখের জলটুকু মুছে দেই”। অনুমতির অপেক্ষা না করেই ডান হাত বাড়িয়ে জলটুকু মুছে দিল।
দীপু বলল, “আমারও খুউব ইচ্ছে করছিল, তোমাকে ছুঁয়ে দেখি”, বলেই দীপু শ্রাবন্তীর হাতটি দু’হাতের মুঠিতে চেপে ধরল। শ্রাবন্তী বোবা হয়ে তাকিয়ে রইল।
এর দু’দিন পরই দীপুকে নিয়ে গেল কলকাতা। আমরা উদ্বিগ্ন চিত্তে সেখান থেকে খবরের অপেক্ষায় থাকলাম। হঠাৎ একদিন সত্যি খবর এলো। আমি দীপুর দেওয়া চাবি দিয়ে ওর ড্রয়ারটা খুলতে গেলাম। সে দিনই মা লোক খবর দিলেন ইউক্যালিপ্টাস গাছটা কেটে ফেলার জন্য।