BD Trade Blogs

মুক্তি


অসীম তরফদার

এ বাজারে ভালো একটা চাকরি পাওয়া যে কত বড় ভাগ্যের ব্যাপার তবু মাথাাটা গরম করে চাকরিটা হারালাম। পাশের বাড়ির মুরাদ ভাই জানলে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বিজ্ঞের মত বলবেন, “আমিতো আগেই বলেছি, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। চাকরি গ্যাছে! এ আর অস্বাভাবিক কি? তোমার মত মাথা গরম ছেলের জন্য এটাই স্বাভাবিক। এখন বোঝো কেমন লাগে! এত কষ্টের চাকরিটা দিলেতো খুঁইয়ে”। 

“ছার, চা লাগবো, চা?” চায়ের ফ্লাস্ক হাতে এক পিচ্ছি পাশে এসে দাঁড়ালো। বেশ শীত শীত লাগছে। এ সময় এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। সন্ধ্যার পরই কুয়াশা ঘিরে ফেলেছে চারদিক। কদিন ধরেই শীতের প্রকোপ খুব বেশি। এ জন্য সন্ধ্যার পরই পার্ক জনশূন্য হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষন হলো এসেছি; বাদাম চিবুতে চিবুতে বেশ কাটিয়ে দিলাম। উঠেতেও ইচ্ছে করছে না। বাসায় ফিরেইবা করবটা কী? তার চেয়ে না হয় থেকেই যাই আরও কিছুক্ষণ। খারাপতো লাগছে না, বরং ভালোই কেটে যাচ্ছে সময়। 

চা শেষ করে উদাস মনে একটা সিগারেট টানছি, আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোয়া ছাড়ছি আর তারা দেখছি। পাশ দিয়ে আমার বয়সী একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে, আমার মতই লম্বা, হালকা ছিপ্ছিপে দেহ। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। পার্কের এ দিকটায় বাতি নেই; আবছা আলোতে মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কাছে এসে বললো, “ভাই, দয়া করে আগুনটা দেবেন”? 

আমি বিরক্তিভরে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে জ্বলন্ত সিগেরেটটা বাড়িয়ে দিলাম। সিগারেটে যখন অগ্নিসংযোগ করল তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এ চোখ দুটো আমার ভীষন চেনা। আমার দিকে সে তাকানোর আগেই আমি আবার অন্যদিকে মুখ ফেরালাম। সিগারেট ফেরৎ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি ভেবে বললাম, এক্সকিউজ মী....

“জী। বলুন”, ছেলেটি ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল। 

আমি অনেকটা অপ্রস্তত হয়ে বললাম, “না, তেমন কিছু না। এমনিতেই। আসলে আপনাকে কেমন চেনা মনে হচ্ছিল”।

ছেলেটি এবার এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর হঠাৎ প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, “আরে অভি, তুই এখানে! আমাকে চিনতে পারিসনি? আমি বাদল।”

“বাদল! দোস্ত, তুই? কতদিন দেখা নেই। কেমন আছিস বন্ধু”? 

বাদল সংক্ষেপে জবাব দিল, “ভালো। তোর কথা বল”। 

“এইতো; আছি কোনো রকম। তা তুই ঢাকায় আছিস কতদিন?”, প্রচন্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে জানতে চাইলাম। 

বাদল উওর দিলো, “আজ সকালে এসেছি”।

“আজ? আছিস কোথায়”?

“হোটেলে। এসেছি একটা বিশেষ কাজে”।

হেসে বললাম, “হোটেলে কেনো? হোটেলে উঠেছিস কোন ধান্দায় শুনি,  হ্যাঁ”? 

শান্ত কন্ঠে বাদল বললো, “নারে দোস্ত, কোনো ধান্দা-ফান্দা নেই। এতদিন বাবার ঔষধের দোকনটাই দেখাশুনা করেছি। এখন ভাবছি নতুন কিছু করা যায় কি না। যাকগে, তোর কথা বলতো এবার”। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “আমি গতবার ডিগ্রী পাশ করে একটা চাকরি জোগাড় করেছিলাম। এক প্রাইভেট কোম্পানীতে, অফিস এক এক্সিকিউটিভ হিসেবে। বেশ ভালোই চলছিল। কিন্ত কাল চাকরিটা চলে গেছে”। 

“চলে গেছে মানে”? অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো বাদল। ওর দৃষ্টিতে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আমি বললাম, “ম্যানেজারের নাক ফাটিয়েছি। এরপর কি চাকরি থাকে, বল? শালা ম্যানেজার, আমাকে বলে কি না বলদ! সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে পেয়ে পাশ করেছি সত্যি, তাই বলে ম্যানেজার হয়েছেন বলেই অফিসের পিওনদের সামনে আমায় যা ইচ্ছে তাই বলবেন? ডান হাতটা কখন মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ম্যানেজারের নাকে আঘাত করেছে নিজেই ঠিক বুঝতে পারিনি”। 

বাদল আমার কাধে হাত রেখে বললো, “এখনও সেই আগের ভাবটা ছাড়তে পারিসনি। এক কথাতেই মেজাজ খানা টপ গিয়ারে উঠে যায়! এখন অন্তত মাথা ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা কর”। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললো, “নে, এবার আরেকটা সিগারেট জ্বালা। আমার কাছে আবার লাইটার নেই”।

সিগারেট নেবার সময় ঠাট্টা করে বললাম, “প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট কিনতে পার আর লাইটার কেনার পয়সা জোটে না? শালা”!

বাদল নিরুত্তর। একটু হাসল শুধু। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে লাইটারের আলোতে বাদলের মুখটা আবার ভালো করে দেখলাম। মুখে দিন সাতেকের না-কামানো দাড়ি। “চেহারার যা হাল করেছিস তাতে সেই আগের বাদলের সাথে মেলানো কষ্ট। এমন রুক্ষ হলো কিভাবে? তবে চোখ দুটোতে এখনও আগের সেই মায়া!” একটু থেমে সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আবার বললাম, “তোর শুভ্রার খবর কি”? 

“ভালোই আছে। কাল বিয়ে”, সংক্ষেপে জবাব দিলো বাদল। 

আমার কাছে পুরো বিষয়টা কেমন যেন অসংলগ্ন মনে হল; কাল বিয়ে অথচ আজ বাদল রুক্ষ চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আবার ভাবলাম বিয়ের কেনাকাটা করতে এসেছে হয়ত। বললাম, “তুমি শালা বিয়ের শপিং করতে এসেছো ঢাকায় আর এতক্ষন আমাকে আসল খবরটিই দাওনি। ভেবেছিলে একা একাই বিয়েটা সেরে ফেলবে! কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না চাঁদ। তা, কি কি শপিং করলি, বল”।

বাদলের চোখে উদাস দৃষ্টি; খুব ধীরে ধীরে বললো, “তোর কথার মত সত্যি যদি বিয়ের শপিং করতে আসতাম তাহলে বিয়ের খবরটা তোকে আগেই দিতাম। কিন্তু...” বাদল কথা থামিয়ে চুপ করে রইল। 

আমি ধমকের সুরে বললাম, “আবার কিন্তু কিরে ব্যাটা? ন্যাকামী! দেখ বাদল, ন্যাকামী আমার মোটেই ভালো লাগে না। যা বলার ঝটপট বল”।

“শুভ্রার বিয়ে আমার সাথে হচ্ছে না”, কাঁপা গলায় উত্তর দেয় বাদল। আমি বাদলের কথা কেড়ে নিয়ে রেগে বললাম, “শালা, বললেই হল! এত বছর ধরে প্রেম করলো তোর সাথে আর এখন বিয়ে হচ্ছে কার সাথে, শুনি”? 

বাদল শান্তভাবে বললো, “অভি, তুই কিন্তু আবার মাথা গরম করছিস। আগে আমার কথা শোন। এক মাস আগে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এক ব্যাংকারের সাথে। নাম সুমন চৌধুরী”। 

আমি মুখ খিঁচিয়ে বললাম, “হুঁ, সুমন চৌধুরী। বললেই হলো! এতদিন ধরে ভালোবাসলি তুই আর এখন কিনা বিয়ে করবে কোথাকার কোনো সুমন না কুমন চৌধুরী”! একটু থেমে আবার বললাম, “ব্যাটা কাপুরুষ! নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে ঢাকায় এসেছে বিরহের রস আস্বাদন করতে!”

বাদল নির্বাক, নিরুত্তর। আমি আবার বলতে লাগলাম, “যাক, ঢাকায় এসে ভালোই করেছিস। না এলেতো আর আমার সাথে দেখা হতো না। আমার সাথে যখন দেখা হয়েই গেছে তখন তোকে আর কিছু ভাবতে হবে না। ধরে নে ব্যাপারটা এখন আমার”। 

নরম গলায় বাদল বললো, “প্লীজ অভি, পাগলামী করে কি লাভ, বল”? 

আমি ধমক দিয়ে বললাম, “ধ্যাৎ শালা, পাগলামী কিসে শুনি? ব্যাপারটা এখন আমার। ডিসিশন ইজ ফাইনাল। নো হ্যাজিটেশন, নো টেনশন। শুভ্রার বিয়ে কালই হবে; তবে সুমনের সাথে নয়; হবে বাদলের সাথে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার”? কথাগুলো বলে তাকালাম ওর মুখের দিকে। কি যেন ভাবল কিছু সময়; তারপর ঠান্ডা মেজাজে ধীরে ধীরে বললো, “এখন মাথা গরম করে কোনো ফল হবে না, অভি। যা কিছু করার ঠান্ডা মাথায় ভেবে করতে হবে”। 

আমার মেজাজটা আরেক ধাপ বিগড়ে গেলো। বললাম, “চির কালইতো তুই পণ্ডিতি করলি; ঠান্ডা মাথায় ভেবে ভেবে কাজ করলি; কিন্তু কি ফল পেলি শুনি”? একটা কাশি দিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম, “আমার ডিসিশন ফাইনাল। চাকরি নেই। অতএব অফিস থেকে ছুটি নেবার টেনশনও নেই। হাতে এখন বিস্তর সময়। কাল সন্ধ্যার মধ্যেই শুভ্রাকে ঢাকায় হাজির করব। তোকে কিচ্ছু করতে হবে না। চুপ করে হোটেলে শুয়ে থাকবি; বুঝলি”? 

মাথা নেড়ে জবাব দিলো বাদল, “বুঝলাম; কিন্তু আজ সারারাত আরেকবার ভাববো”। বাদল একটু থামল; তারপর মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “কাল সকাল ন’টায় একবার হোটেলে আয়, তখনই ফাইনাল করব সব। এই আমার হোটেলের কার্ড, রুম নম্বর ২০৫”। কার্ডটা মানিব্যাগে ঢুকিয়ে বললাম, “চল, আজ তাহলে ওঠা যাক”। 

“হ্যাঁ, চল। বেশ ঠান্ডা পড়েছে; এখন ফেরা উচিৎ” উঠে দাঁড়িয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভর্তি গাল চুলকে কি যেন ভাবল বাদল। তারপর বললো, ‘‘তুই কি ভাবে যাবি”? 

‘‘আরে আমার কথা বাদ দে। আগে তোকে রিক্সায় উঠিয়ে দেব। তারপর আমি হেঁটেই চলে যাব। আমারতো মাত্র কয়েক মিনিটের পথ”।

একটা খালি রিক্সা ডেকে বাদলকে শুভরাত্রি জানিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। পার্ক সংলগ্ন মসজিদ পেড়িয়ে, গীর্জা পেড়িয়ে কাকরাইলের দিকে হেঁটে চলেছি। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। শীতের প্রকোপ বেশি বলেই লোকজনের চলাচল কম, গাড়ির সংখ্যাও কম। কয়েকটি পাথরের টুকরা কুড়িয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনে হেটে চলেছি। বারবার বাদলের মুখটাই তবু চোখের সামনে ভাসতে লাগল।

লেখা-পড়ায় কখনই ভালো ছিলাম না আমি; বখে গিয়েছিলাম ছোট বেলাতেই। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় সিগারেট ফুঁকতে শিখেছিলাম। কাজেই কলেজে এসে রাজনীতিতে ঢুকব, মাস্তানি করব এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাদলের বেলায় এটা আশাই করা যেত না। স্টার মার্ক নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করে ভালো লেখা-পড়ার আশায় ময়মনসিংহের ভালুকা হতে বাদল এলো মানিকগঞ্জ; ভর্তি হলো সরকারী দেবেন্দ্র কলেজে; উঠল কলেজ হোষ্টেলে। স্থানীয় হওয়া সত্ত্বেও আমি হোষ্টেলে উঠলাম; কারণ হোষ্টেলে থেকে ছাত্র রাজনীতিতে সুবিধা পাওয়া যায় বেশি।

একদিন ডাইনিং রুমে পরিচয় হলো বাদলের সাথে। জানলাম, কলেজে এ বছর ভর্তি হওয়া ছাত্রদের মধ্যে বাদল সর্বোচ্চ নম্বরধারী। ওকে আমি অন্য চোখে দেখতে শুরু করলাম। নিজে ভালো না হলেও ভালো ছাত্রদের নষ্ট করার কিংবা পড়া ক্ষতি করার মানষিকতা ছিল না আমার। কিন্তু সিনিয়ার লিডার ও ক্যাডার ভাইয়েরা বড্ড নাছোরবান্দা!

বিশেষ কাজে একবার আমাকে এক মাসের জন্য যেতে হলো ক্যাম্পাসের বাইরে। ফিরে এসে আবিষ্কার করলাম নতুন এক বাদলকে। হোষ্টেলের সর্ব পশ্চিমের রুমে চুপচাপ বই নিয়ে বসে থাকা বাদল তখন মিছিলের প্রথম সাড়িতে। বড় ভাইয়েরা যে কি মন্ত্র দিয়ে বশ করে! ভাবলে অবাক হতে হয়! বাদল রুম পরিবর্তন করে চলে এলো আমার রুমে। বিস্ময়ভরে দেখেছিলাম একটা প্রতিভার ছন্দপতন, একটা নক্ষত্রের কক্ষচ্যুত হওয়া। তবে এ ভাবনা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আমরা রাজনীতি করি; কার ক্ষতি হলো, কে গোল্লায়  গেলো এ নিয়ে ভাবা আমাদের মানায় না!

হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম রাজমনি সিনেমা হলের সামনে। সান্ধ্যকালীন শো ভাঙল মাত্র। খুব ধীরে ধীরে হাঁটছি; ঘুরে ফিরে আবার বাদলের কথাই মাথায় এলো। কলেজের সেই দিন গুলোতে আমাকে পেল শুধু এক রাজনীতিতে আর বাদলকে পেল দুটোতে- রাজনীতি এবং প্রেমে। নষ্ট রাজনীতি যাকে পেয়ে বসে তার উন্নতির পথ বন্ধ হয় জানতাম, কিন্তু যাকে প্রেম আর রাজনীতি একসাথে পেয়ে বসে তার পরিণাম কি হয় জানা ছিল না। বিশেষ করে রাজনীতি যদি হয় নষ্ট আর প্রেম যদি হয় অন্ধ। সারা বছর রাজনৈতিক কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়ন শেষে পরীক্ষায় একটা মনোরম সেকেণ্ড ডিভিশন পেলাম; আর বাদলের কথা না বলাই ভালো; সরস্বতী দেবীকে লম্বা একটা প্রণাম জানিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেল শূন্য হাতে।

তারপর কেটে গেছে তিনটি বছর। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর ঢাকায় চলে এলাম। এর মাঝে বাদলের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। আজ ওর একটা চরম সংকটের মুহূর্তে ওর সাথে আবার দেখা! বাদলের সমস্যা মানে আমার সমস্যা; কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে কলেজ জীবনের দুটো বছর জুড়ে! একটা কিছু করতেই হবে। রুমের কাছে পৌঁছে দরজার তালা খুলতে গিয়ে মনে হলো, আসলাম ভাইকে একটা ফোন করতে হবে; বললে একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবেন। 

সকালে ঘুম থেকে জেগে ঘড়ির দিকে তাকাতেই লাফিয়ে উঠলাম। সর্বনাশ! সাড়ে আটটা বেজে গেছে। হাতে সময় মাত্র আধা ঘন্টা। বাথরুমে গোসল সেরে পোশাক পড়ে তৈরি হয়ে রাস্তার মোড়ে এলাম। আসলাম ভাইয়ের পাঠানো সাদা রঙের মাইক্রোবাস দাড়ানো; নম্বর দেখে নিশ্চিত হয়ে সংকেত দিতেই ড্রাইভার সালাম জানিয়ে দরজা খুলে দিলো। ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে পড়লাম। ড্রাইভার গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে বললো, “বড় ভাইয়ের আটজন লোক জিনিস লইয়া মগবাজার রেল ক্রসিংয়ের পাশে রেডি হইয়া আছে। যাওয়ার সময় তুইল্যা নিলেই হইব”। 

বাদলের কার্ড দেখিয়ে বললাম, “ঠিক আছে। সময় মত তুলে নেয়া যাবে। এখন তুমি এই হোটেলে যাও। ওখানে একজনের সাথে প্রথমে দেখা করতে হবে। তারপর ওদের নিয়ে মানিকগঞ্জ যাবো”। ড্রাইভার কোনো কথা বললো না; গাড়ী ষ্টার্ট দিলো। 

হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন ন’টা বেজে দশ মিনিট। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে হেঁটে রিসেপশনে গিয়ে বাদলের খোঁজ করতেই জবাব শুনে সারা শরীরে একবার যেন বিদ্যুত স্ফুলিঙ্গ খেলা করে গেলো! সেই ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাদল হোটেল থেকে চেক আউট করেছে। আমার নামে একটা খাম রেখে গেছে। বড় বড় অক্ষরে আমার নামাঙ্কিত খামটি হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম। খাম ছিঁড়ে একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। 

প্রিয় অভি, তোকে আসতে বলে নিজেই পালিয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই ভীষণ ক্ষেপে গেছিস, তাই না? কিন্তু আমার কথাগুলো শুনলে অবশ্যই তুই বুঝবি, এমনকি ক্ষমাও করতে পারবি, এটাই আমার বিশ্বাস। কথায় আছে, একবার না পারিলে দেখো শতবার। কিন্তু শতবার দূরের কথা, দ্বিতীয়বারও চেষ্টা করার সাহস পেলাম না; তাই লেখা-পড়ায় ইতি টেনে বাবার ঔষধের দোকান চালানোর দায়িত্ব নিলাম। বিদ্যাদায়িনী আমার থেকে মুখ ফেরালেও প্রেমদায়িনী দেবী বোধ করি আমার উপর সুপ্রসন্নই ছিলেন।

তাই বইপত্র গুলো আমাকে ছুঁড়ে দিলেও শুভ্রা আমাকে জড়িয়ে রাখলো ভালোবেসে, দু’চোখে স্বপ্ন এঁকে। ছয় মাস আগে একদিন শুভ্রা আমার বুকে মাথা রেখে বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বললো। আমি এক বছর সময় চেয়ে নিলাম, নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্য, বিয়ের প্রস্তুতির জন্য। বাবাকে বলে আরেকটি দোকানের ব্যবস্থা করলাম, যে দোকানের সমস্ত মালিকানা বাবা আমার নামে করে দিলেন। দোকানের ডেকোরেশনও ইতোমধ্যে শেষ। সপ্তাহ খানেক বাদেই উদ্বোধন করার কথা ছিল। শুভ্রা বলেছিল, যদি মা-বাবা তোমার সাথে বিয়েতে রাজী না হন, তাহলে আমি তাদের ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসবো, তোমার হাত ধরে। তোমার সাথে আমি নরকেও যেতে রাজী।

সেই বিশ্বাসে, একমাস আগে যখন ওর বিয়ে ঠিক হলো, তারপর একদিন সুমন চৌধুরীর সাথে দেখা করে বুঝিয়ে বললাম সব। কিন্তু শুভ্রা যখন জানলো আমি সুমন চৌধুরীর সাথে দেখা করেছি তখনই সে আমার কাছে ছুটে এলো; বললো, মা বাবার মুখে চুনকালি মেখে আমার সাথে সে আসতে পারবে না। আমার হাত ধরে মিনতি করল, যেন ওর বিয়েতে বাঁধা হয়ে না দাঁড়াই।

অভি, মেয়েদের চোখের জলের যে এত মারাত্মক শক্তি তা আগে জানা ছিল না। মাত্র দু’ফোটা অশ্র“ আমার ভেতরের সমস্ত ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান সব মুহূর্তেই মাটি করে দিলো; ওকে আমি মুক্তি দিয়ে এলাম, আমার মন থেকে, প্রেম থেকে, আমার জীবন থেকে। এরপরই অনেকটা অলৌকিক ভাবে কুয়েতে যাবার ভিসা পেয়ে গেলাম। নতুন দোকান বিক্রি করে যাবার খরচ জুগিয়েছি। বাংলাদেশ ভূখন্ড ত্যাগ করার আগে কাউকে জানাবো না বলে স্থির করেছিলাম। তাই তোকেও বলা হয়নি। যদি পারিস ক্ষমা করে দিস। 

আমি জানি, আমাকে কতটা ভালোবাসিস তুই। সমস্ত দায়িত্ব নিজে নিয়েছিলি। কিন্ত আমি যে ওকে মুক্তি দিয়েছি। যাকে হৃদয় দিয়ে বাঁধতে পারিনি, তাকে বাহুবলে বেঁধে কি লাভ! হৃদয়ের কাছে বাহুবল কত তুচ্ছ! অমাবস্যার অন্ধকার-ঘেরা এক বাদলা-রাতে আমার জন্ম হয়েছিল বলে মা-বাবা আমার নাম রেখেছিলেন বাদল। সেই অশুভ জন্ম-মুহূর্তের মতো শুভ্রার জীবনে বাদল হয়ে নাই বা রইলাম। তার চেয়ে বরং সুমন চৌধুরী সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হয়ে ওর জীবনকে সুখময় করে তুলুক। আমাকে দু:খ দিলেও বিধাতা যেন ওকে সর্বদিকে সুখি করেন। আজ যখন বিয়ের সানাই বাজবে, তখন আমি অবস্থান করব বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে, আরব সাগরের তীরে। যাবার আগে তোর যে ভালোবাসা, সাহচার্য পেয়েছি, সে কথা মনে থাকবে সারাজীবন। আমার জন্য দোয়া করিস, যেন জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে পারি। ইতি- বাদল।

চিঠিটা ভাঁজ করে খামে রাখলাম। কখন যেন চোখের কোণে দু'ফোটা জল এসে গেছে, টের পাইনি ঠিক। চোখে বুজে মাথাটা সীটের সাথে হেলিয়ে দিলাম। বাদলের মায়াভরা চোখ দুটি আবার ভেসে উঠল মনে।


সাহিত্য >> গল্প ও ছোট গল্প