সকল দোষ শুধুই সরকারের। আর আমরা সবাই গঙ্গা জলে স্নান করা একেক জন শুদ্ধ মানুষ ! আমরা কি কখনো ভুল করতে পারি ! এই করোনা মহামারীর মধ্যে সরকারই তো শপিং মল খুলে দিলো; তাহলে আড়ং সহ অন্যান্য মার্কেট ও মলে যে এতো মানুষের ভিড় আর সেই ভিড়ের মাঝে আমি গেলাম- এতে আমার দোষ কোথায় !?!
কথায় কথায় আমরা শুধু সকারের সমালোচনা করি; কিন্তু আত্মসমালোচনা কখনো করি কি ? অন্যের ভুলগুলো যেমন করে ধরার চেষ্টা করি তেমন করে নিজের ভুলগুলো কি একটু দেখি বা দেখবার চেষ্টা করি? সরকারের কোনো ভুল নেই কিংবা দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যা নেই এরকম কোনো কথা আমি মোটেও বলতে চাইছি না. বরং আমি বলতে চাইছি, সরকারের দোষ খোঁজার পাশাপাশি নিজের দায়িত্ব বোধ সম্পর্কে যেন কিঞ্চিৎ সগাজ থাকি, নিজের ভুল ত্রুটি গুলোও যেন একটু খতিয়ে দেখি।
প্রতিনিয়ত আমরা সরকারকে নানা পরামর্শ, উপদেশ, জ্ঞান বিলিয়ে যাই। স্বাধীন দেশে এই অধিকার হয়তো সবারই আছে। ভাইরে, দায়িত্বের বাইরে থেকে সমালোচনা করা যতটা সহজ দায়িত্বে থেকে যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালন করা ঠিক ততটা সহজ নয়। আমরা তো ছোট-খাটো এক-দুটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাধারণ দু-একটা সামাজিক সংগঠন, ক্লাব চালাতে গিয়েই দেখি, আমাদেরকে কত কিছু মেনে নিতে হয়; কত কিছুর সাথে আপোষ করতে হয়; কত সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। ব্যবসা বা চাকুরী, ক্লাব বা সংগঠন পরিচালনায় ব্যর্থদেরও যখন 'সকারের এই মুহূর্তে কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয়' বলে উপদেশ বাক্য বিলিয়ে বেড়াতে দেখি তখন সত্যি অবাক হতে হয়।
সমাজের সকল স্তরের মানুষকেই সরকারের দুর্নীতির ব্যাপারে দারুন ভাবে কথা বলতে দেখি। বেশ ভালো লাগে। কিন্তু কথা হলো, সরকার কি উর্ধাকাশের কোনো তারা ? সরকারের মধ্যে যারা আছেন তারা আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ। আমাদেরই কারো না কারো মা, বাবা, চাচা, চাচী, ফুপু, ফুপা, মামা, মামী, ভাই বা বোন, আমাদেরই আত্মীয়-স্বজন । এর বাইরেও আরো দিক আছে। আসুন এবার দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে দেখি। আমার বা আপনার পরিবারে বা আত্মীয়দের মধ্যে কিংবা চারপাশে যে মানুষগুলো আছেন, তাদের মুখগুলো আসুন এবার একটু স্মরণ করি। কি, কিছু দেখতে পাচ্ছেন? যে প্রকৌশলীকে দেখছেন, উনি নানা কৌশলেই দু'হাতে টাকা কামান; যে চিকিৎসককে দেখছেন উনি টেস্টের কমিশন, ঔষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ফ্রি ঔষধ সহ নানা অনৈতিক সুবিধা পেয়ে পেয়ে অগাধ টাকার মালিক; যে শিক্ষককে দেখছেন উনিও ক্লাসে ঠিক-ঠাক না পড়িয়ে প্রাইভেট আর কোচিংয়ে পরিয়ে বেশ ভালোই কামান। যে সরকারি কর্মকর্তা এমনকি কর্মচারীকে দেখছেন তাদের কথা কি বলে দিতে হবে? যে ব্যাংকারকে দেখছেন উনিও কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়ে কিছু কমিশন কমিয়ে নেন। যে মার্চেন্ডাইজারকে দেখছেন, তিনি কিন্তু পার্সেন্টেজ না পেলে কোনো সাপ্লাইয়ারের স্যাম্পল এপ্রুভ করেন না। আজকাল অনেক প্রাইভেট কোম্পানিতে কমার্শিয়াল/পারচেজ ডিপার্টমেন্ট, একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট সহ নানা ক্ষেত্রে নানা রকমের ব্যাপার স্যাপার আছে। এ রকম কত কিছুইতো দেখলেন... সব বলতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে ! তবু শেষ করা কষ্টকর। দুধে জল মিশিয়ে, খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে, ঔষধের নকল করে, মানুষের পাওনা টাকা না দিয়ে, অপরের সম্পদ হাতিয়ে, অপরকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেও অগণিত আমরা শুধু সরকারের দুর্নীতিই দেখতে পাই, নিজেদের দোষগুলো এতটুকু নজরে আসে না ! আমাদের মধ্যে আমরা সবাই দুর্নীতির সাথে জড়িত তা কিন্তু মোটেও বলছি না। আমরা আবার অনেকেই কিন্তু সুযোগের অভাবে সৎ! হ্যাঁ, আমরা অনেকই আছি যারা সত্যিকার অর্থেই সৎ; সুযোগ থাকা সত্বেও সকল প্রকার লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাসিতার উর্ধ্বে থেকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যান। তাঁরা সত্যিকার অর্থেই নমস্য !
আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলব না, আমি এটা মোটেও বলছি না। আমি আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধির উপরে জোর দিয়েছি এ কারণে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানটা না হয় আমার নিজেকে দিয়েই প্রথম শুরু করি। সৎ অথচ দরিদ্র আত্মীয়কে অসম্মান করে বা কম গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতিবাজ পয়সাওয়ালা আত্মীয়কে অধিক সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলাটা আমার কাছে দ্বিচারিতাই মনে হয়। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের সাথে সহাস্য সেলফি তুলে সগৌরবে ফেসবুকে প্রচার করে নিজের আভিজাত্য, কৌলিন্য ও ক্ষমতার দৌড় প্রকাশের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানটাও বড্ড বেশি দ্বিচারিতাই বৈকি !