BD Trade Blogs
> Blogs > কবিতা > বিসর্জন

বিসর্জন


অসীম তরফদার

পশ্চিমের ঘাট ধরে সূর্যটা ডুবেছে অনেক আগেই
পাখিরাও ঝাঁক ধরে ফিরে গেছে নীড়ে
নদীর ধারে যারা এসেছিলো তারাও ফিরে গেছে একে একে।
সন্ধ্যা নামার আগেই চলে গেছে নিপা,
একদা যাকে আমি ভালোবেসে হৃদয়মন্দিরে আসীন করেছিলাম
আরাধনা করেছিলাম আজন্ম তার ভালোবাসায় আপ্লুত হবো বলে,
গোধূলির ধূসর আলোয় আমার সেই স্বপ্নচারিণী দেবীর
বিসর্জন হলো আজ, এই নদীতীরে, মাত্র কয়েক মূহুর্ত আগে।
এমনই এক গোধূলি লগনে
নিপা একটি লাল গোলাপ দিয়ে বলেছিলো -
“এটা গোলাপ নয় - এ আমার হৃৎপিণ্ড, আমার জীবন!
আজ থেকে ওটা তোমার কাছেই বন্ধক রাখলাম।”
হেমন্তের শেষ বিকেলের হলুদ বাদামী আলো এসে পড়েছিলো
তার চোখে-মুখে, মনে হলো চোখ দুটো ঝর্ণার জলের মত স্বচ্ছ,
সে চোখের গভীরে সেদিন আমার ভালোবাসা খুঁজেছিলাম
আর পরম তৃপ্তিতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে
চুম্বন এঁকেছিলাম কপালে।


একবার একটা কাজে নিপাদের দক্ষিণের ঘরে থাকতে হয়েছিলো
কয়েকটা দিন, সে ঘর থেকে নিপার ঘরটি দেখা যায়-
সুযোগ পেলেই জানালা দিয়ে চোখের ইশারায়
কত কথা বলেছি তার কোনো হিসেবই নেই।


নিপা খুব বেশি সুন্দরী ছিলো না কিন্তু সাজতে ভালোবাসতো,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতো সুন্দর করে
আর আমি অব্যক্ত মুগ্ধতায় তাকে দেখতাম শুধু।


ফাইনাল পরীক্ষার আগে নিপা শেষরাতে উঠে পড়ত
যদিও ছাত্রী হিসেবে বিশেষ সুবিধের ছিলো না সে,
পড়া শেষ করে ভোর বেলায় একদিন
দক্ষিণের ঘরের জানালায় এসে জাগালো আমায়;
আর কেউ জাগেনি তখনও
নিপা আমাকে নিয়ে গেলো তার শেফালী গাছের নীচে।
পূবের আকাশ কিছুটা লাল হয়েছে সবে, বাতাসে হালকা কুয়াশা
শেফালী পাতা বেয়ে দু’এক ফোঁটা শিশির ঝরছে মাথায়
পড়ছে কিছু শেফালী ফুলও ঝরে
নিপা কয়েকটি ফুল তুলে নিল হাতে,
আমার হাতটি নিয়ে রাখল তার হাতের উপর
ভোরের সে আলোয় নিপাকে দেখাচ্ছিলো ভীষণ শুভ্র ও স্নিগ্ধ।
সে তার কোমল হাতে আমার হাতখানি নিয়ে খেলায় মেতে রইল
কিছুটা সময়, তারপর চোখ তুলে তাকালো আমার চোখে;
“তোমার এ হাতখানি আমি ছাড়ব না কিছুতেই
সারাজীবন পাশে থাকব, যত বাধাই আসুক, দেখো;
তুমি আমায় ভূলে যাবে না তো? ছেড়ে যাবে না তো কোনোদিন?
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না একদিনও।”
আমরা মোহাবিষ্ট হই এক মধুর স্বপ্ন ও কল্পনায়।


কবিতা ভালোবাসতো নিপা,
প্রায়ই আমার কবিতা নিয়ে পড়ত সে
কবিতা গুলো জীবন্ত হতো তার কন্ঠে, উৎসাহ পেতো প্রশংসায়।


বর্ষার এক বিকেলে সে বলেছিলো -
“আজ তোমায় সাথে করে নিয়ে যাব প্রেমনগরে
আসল নাম নয় এটি, তবে যুগলেরা এ নামেই চেনে জায়গাটাকে!
শুনেছি সেখানে নদীর কুলে কাশবনে সাদা সাদা ফুলগুলো
দোল খায় দখিনা বাতাসে, গাংচিল বেড়ায় উড়ে
নদীর জলে আপন মনে ভেসে যায় হংসসারি,
সেখান থেকে দেখা যায় দূরে মাঝনদীর চর;
যুগলেরা সেখানে প্লাবিত হয় ভালোবাসায়
আজ আমরাও আবিষ্ট হবো, তোমাকে দেব আমার প্রথম চুম্বন।”
সেদিন আমার মনে আনন্দের বান ডেকেছিলো
বুকের মধ্যে ঝিলিক দিয়েছিলো আশা-আপ্লুত স্বপ্নেরা;
হঠাৎ অঝোর বর্ষণ সেই স্বপ্নকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো
প্রেমনগরে যাবার বদলে আমরা ভিজতে ভিজতে
ফিরে এলাম ঘরে।


আমাকে ভালোবাসে জেনে একদিন ওর মা বকেছিলো খুব
সেদিন আমার কাছে এসে অনেক কেঁদেছিলো নিপা,
কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলো-
যে যা খুশী বলুক, আমি তোমায় ছাড়া বাঁচব না;
যতদিন বাঁচব ততদিন শুধু তোমারই হয়ে থাকব
তুমি শুধু এমনি করেই ভালোবেসো আমায়।”


আমাদের ভালোবাসার স্বপ্নীল উঠোনে তখন
নেচে বেড়াত ফিঙ্গে, শ্যামা, বুলবুলি, কাকাতোয়া;
আমাদের আকাশে উড়ত রং-বেরংয়ের ঘুড়ি
হেমন্ত দিনের মত মেঘমুক্ত সে আকাশে কেবলই
খেলা করত সোনালী রোদ্দুর।


হঠাৎ একদিন সেই নির্মল আকাশ ছেয়ে গেলো কাল মেঘে;
আমাদের আপনজনেরা, যারা নিজেদের দাবি করেন
আমাদের মঙ্গলাকাক্সক্ষী বলে, তারা
আমাদের মনের চাওয়াকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে
দুজনার মাঝখানে গড়ে দিলেন দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর।
আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম,
আমার কানে আর ঝংকার তুলে না তার সহাস্য কথামালা
নীলখামে আর আসে না তার চিঠি
গেঁথে দেয় না শিউলী মালা নি:সীম মমতায়।
আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না,
নিপা আর এলো না, হয়ত আসার চেষ্টাও করল না।


তারপর...
পেশাগত কাজে আমি নির্বাসিত হই।
হঠাৎ ক’দিন আগে খবর পেলাম-
নিপা ডেকেছে আমায়, খুব জরুরী।
কিছুটা উৎফুল্ল ও খানিকটা ব্যাকুল চিত্তে ছুটে এলাম আমি;
হয়ত সেখানে জেগেছে এক নতুন সম্ভাবনা
আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন এক পথ,
যে পথ একদা বিলীন হয়েছিলো চার বছর আগে।


বুকের মাঝে অসীম আশার ডালি সাজিয়ে
প্রতীক্ষার প্রহর গুনে গুনে যখন এলাম নিপার কাছে
তখন তাকে মনে হলো ঝরা পাতা, বিমর্ষ
ও বৈরী বাতাসের মত অস্থির,
শ্বেত গোলাপের পাপড়ি গুলো অকারণে ছিঁড়তে লাগল
আর সেদিকেই দৃষ্টি স্থির রেখে বলল-
“কি করে যে তোমায় বলি?
আসলে খুব বড় একটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছি আমি
তুমি চেন তাকে, শোভন, আমার ভালোবাসার জন্য
যে সব সময় কাঙালের মত ঘুরত।
তোমার সাথে যখন বন্ধ হয়ে গেলো সব যোগাযোগ
তখন কি করে যেন জড়িয়ে গেলাম আমি,
ভীষণ ভালোবাসে আমায় এবং আমিও তাকে;
তাইতো মুক্তি নিতে এসেছি আজ।
তোমার জন্যেও বড্ড মায়া হয় আমার, তোমায় ঠকিয়েছি আমি
ক্ষমা করে দিও আর আমাদের আশীর্বাদ করো।”


নিপা শুধু একবার চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে
সে চোখের তারায় আমি আবার আমার ভালোবাসা খুঁজলাম;
সেখানে তার আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই।
ফেলে যাওয়া শ্বেত গোলাপটি পড়ে রইল পথের ধুলায়
অনাদরে, অবহেলায়।
তোমার কাছে আমার একটা পাওনা রয়ে গেলো
তোমার সাথে প্রেমনগরে যাওয়া হলো না আর,
আজ হলো জলাঞ্জলী আমার সকল সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার।


নিপা, এখনও কি তুমি পড়তে বস শেষরাতে উঠে?
তোমার শেফালী গাছে এখনও কি ফুল ফোটে
নাকি ফোটে না আর?
শিশির কি ঝড়ে পড়ে না এখন শীতের প্রভাতে?
তুমি কি করে পারলে, নিপা !
শোভনলাল কেমন অনায়াসে আমার বুক থেকে
তোমায় কেড়ে নিয়ে গেলো,
আমি বড় একা হয়ে গেলাম
পৃথিবীতে আপন বলে ভাবার মত কেউ রইল না আর
আমার স্বপ্নের সাজানো বাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলো
আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
তবুও নিপা, তোমাদের জন্য আমার আশীর্বাদ।


সাহিত্য >> কবিতা