গতকাল রাতে দ্বাদশীর চাঁদ যেনো আকাশে রুপালি আলো ঢেলে দিয়েছিলো। অনিকেতের ছোট্ট ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়েছিলো, কিন্তু সেই আলোর তলে তার মনে এক গভীর অন্ধকার। সারারাত ঘুম আসেনি। চোখে বারবার ভেসে উঠেছে শুধু একটি মুখ- অনন্যার সেই দুটো বিষণ্ণ চোখ আর সেই চোখের সকরুণ চাহনি।
ইদানিং অনিকেতের কাছে রাতগুলো যেনো একেকটি অনন্ত যন্ত্রণার অধ্যায়। গতকাল রাতেও তার দুচোখের পাতায় ঘুম আসেনি, একটুও না। সারারাত অদৃশ্য এক যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরেছে সে, ঠিক পতঙ্গের মতো ছটফট করতে করতে। বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে বারবার চেষ্টা করেছে ঘুমের আরাধনা করতে। কিন্তু তন্দ্রাদেবী যেনো তার প্রতি রুষ্ট- তাকে ছুঁয়েও দেখেনি।
অনিকেত বারবার উঠে ঘর পায়চারি করেছে। কখনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থেকেছে। রাতের গভীর নীরবতায় দূর আকাশে থাকা জেগে থাকা নক্ষত্রগুলো যেনো তার এই নিঃসঙ্গতা আর ভেতরের দহন নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। সে কতবার চেষ্টা করেছে একটি ভালোবাসার কবিতা লিখতে। কলম হাতে নিয়েই থমকে গেছে। তার ভেতরের ছন্দ হারিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে বোধের সমস্ত সুরও।
অনিকেত আবার উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলো, কেনো এই স্মৃতি তাকে এতটা ধ্বংস করে দিচ্ছে। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। তার ভেতর একটাই উপলব্ধি হলো- কেউ যদি একবার অন্তরের গভীর থেকে ভালোবাসে, তবে তার ছায়াও জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে ছাপ রেখে যায়।
নিজের অক্ষমতায় বিরক্ত হয়ে আবার শুয়ে পড়লো, ঠিক মৃত মানুষের মতো চোখ বন্ধ করে। ভেবেছিলো, ঘুম এসে মুক্তি দেবে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নামেনি। বরং মনে হানা দিয়েছে অতীতের বিবর্ণ কিছু ছবি। সেই স্মৃতিগুলো এতটাই জীবন্ত ছিলো যে, সে বারবার অনন্যার মুখ দেখতে পাচ্ছিলো—অশ্রুভেজা চোখ, অসহায় মুখের আবেগ। যেনো তাকে বারবার দুঃখ দিয়ে চলে যাওয়ার অপরাধে দায়ী করছে। অনন্যার সেই বিদায়ী চোখ, তার মায়াবী মুখের ছাপ অনিকেতের হৃদয়ের গভীরে আজও জীবন্ত।
অনন্যা ছিলো জোছনার মতো স্নিগ্ধ—তার সারল্য আর কোমলতায় যেনো এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধন। ঠিক যেমন জোছনার আলো অন্ধকার রাতকে রাঙিয়ে তোলে, তেমনি তার ভালোবাসা একসময় অনিকেতের জীবনকে পূর্ণ করেছিলো অদ্ভুত এক আনন্দে। তার সহজ-সরল স্বপ্ন আর মন ভোলানো হাসিতে অনিকেত খুঁজে পেয়েছিলো নিজের বেঁচে থাকার মানে।
অনন্যার চোখে ছিলো ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন। অনিকেতের কাছে এই স্বপ্নগুলো ছিলো প্রথমে শুধু শোনার আনন্দ। কিন্তু ক্রমে সে নিজেই সেই স্বপ্নের অংশ হয়ে উঠেছিলো। অনন্যার উচ্ছ্বাসে মুগ্ধ হয়ে একসময় তার নিজের মনও বিভোর হয়েছিলো। প্রতিটি আশান্বিত সকাল, উদাস দুপুর, বিষণ্ন বিকেল কিংবা ক্লান্ত গোধূলি এমনকি জীবনের সমস্ত চড়াই-উতরাই, সুখ-দুঃখের পথ কেবল অনন্যাকে নিয়েই পাড়ি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলো সে।
কিন্তু আজ সেই ভালোবাসার উষ্ণতা নেই। সেই আলো আজ শীতল এক স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে অনিকেতের কাছে। তার হৃদয়ের গভীর থেকে ভেসে আসে একটাই নাম—অনন্যা। কিন্তু সেই নাম উচ্চারণ করাও যেনো তার জন্য এক অসহনীয় যন্ত্রণা।
অনন্যা, যার ভালোবাসায় একসময় মুক্তি খুঁজেছিলো অনিকেত, সেই ভালোবাসা আজ শূন্যতার মাঝে পরিণত হয়েছে এক বেদনাদায়ক স্মৃতিতে। জোছনার মতো মায়াময় মেয়েটি আজ কোথায়? তার সরলতা, তার কোমলতা আজও অনিকেতের অন্তরে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে জেগে থাকে।
অনন্যার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিলো তাদের এক কমন বন্ধুর বিয়েতে। শাড়ি পরা, চুড়ি ঝনঝন করা সরল মেয়েটি নিজের সাধারণ হাসিতেই পুরো পরিবেশটা বদলে দিতে পারতো। অনিকেত তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না- এতটা উজ্জ্বল ছিলো মেয়েটি।
কথাবার্তার মাঝেই, অজান্তে, তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনন্যার চোখে ছিলো এক ধরনের শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস, যা সহজেই অনিকেতকে মুগ্ধ করেছিলো। তাদের প্রথমদিকে কথা হতো খুচরো বিষয় নিয়ে—কখনো পড়াশোনা, কখনো বই, কখনো মেঘলা আকাশ।
এক শরতের বিকেলে কাশবনে ঘুরতে গিয়ে অনন্যার হাত ধরে হাঁটছিলো। এক সময় হঠাৎ থেমে অনিকেত বলেছিল, "তোমার এই হাসি, অনন্যা, আমার পৃথিবী"।
"আর তোমার ভালোবাসা আমার বেঁচে থাকার মানে," মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলো অনন্যা।
তারা এমন এক জগৎ গড়েছিলো, যেখানে কেবল ছিলো ভালোবাসার ছোঁয়া, গভীর মায়ার বাঁধন। অনন্যা তার ভালোবাসার মুঞ্জরীতে সাজাতে চেয়েছিলো তাদের প্রতিটি সকাল, দুপুর, বিকেল আর রাতকে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই থাকবে ভালোবাসার রঙে রাঙানো।
এক বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটতে হাঁটতে অনন্যা হঠাৎ বলে উঠলো, “জানো, আমি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখি একটা সাম্পানে চেপে নদীর মাঝখানে হারিয়ে যাবো। চারপাশে শুধু পানি, বাতাসে ভেসে আসবে শালিকের ডাক আর আকাশটা থাকবে মেঘে মেঘে ঢাকা। সেই জায়গায় যদি আমার প্রিয় মানুষটা থাকে, তাহলে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না।”
অনিকেত হেসে বললো, “তোমার স্বপ্নগুলো এমন মিষ্টি কেনো? কেউ শুনলে বলবে, তুমি কোনো ফেয়ারিটেলের চরিত্র!”
অনন্যা মিষ্টি হেসে তাকালো। “জীবন এত কঠিন, এত যান্ত্রিক। স্বপ্নগুলো যদি সহজ না হয়, তাহলে বাঁচা যাবে কীভাবে? জানো, আমি তো চাই আমাদের একটা ছোট্ট বাসা হবে। একটা খোলা বারান্দা, যেখানে শীতের সকালে রোদ পোহাবো। তুমি চা খাবে, আমি তোমার জন্য পিঠা বানাবো। আর সন্ধ্যায় মেঘলা আকাশ দেখে ভাববো, আমরা দুজন যেনো একটা জগতের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”
অনিকেত হেসে বললো, “তাহলে আমাদের বিয়েটা কোথায় হবে? কোনো ঝমঝমে হোটেলে?”
অনন্যার চোখ বড় হয়ে গেলো। “নাহ্! সেরকম কৃত্রিম জায়গায় নয়। বরং কোনো গ্রাম্য পরিবেশে, যেখানে আমগাছের নিচে বিছানো হবে মোটা কাপড়। লাল শাড়ি পরে তোমার পাশে বসে সবাইকে দেখবো, কতটা খুশি। কোনো ফাঁকিবাজ আয়োজন নয়, একেবারে আপনজনদের নিয়ে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান।”
অনিকেত তার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। অনন্যার স্বপ্নগুলো যে এত সহজ, এত নির্ভেজাল, সেটা তার কল্পনাতেও ছিলো না।
“তোমার কোনো দামি ইচ্ছা নেই? বড় কোনো গাড়ি, বড় বাড়ি?”
অনন্যা একগাল হেসে বললো, “যে মানুষটাকে ভালোবাসি, সে পাশে থাকলে আমার সবই আছে। গাড়ি বা বাড়ি কি সত্যি সুখ এনে দিতে পারে?”
এই কথাগুলো শোনার পর থেকেই অনিকেতের ভেতর অনন্যাকে নিয়ে এক গভীর আবেগ জন্ম নিলো। সে মনে মনে ভাবলো, এই মেয়েটাকে ভালোবাসা শুধু একটা অনুভূতি নয়, এটা একধরনের আশীর্বাদ। সেই দিনগুলোতে, যখনই তারা ব্রহ্মপুত্রের তীরে দেখা করতো, অনন্যার স্বপ্নের বুনন যেনো আরও গাঢ় হয়ে উঠতো।
একদিন, একটা সাম্পান ভাসতে দেখে অনন্যা ইঙ্গিত করে বলেছিল, “তুমি কি জানো, এমন একটা সাম্পানে যদি বিয়ের পর তিনটা দিন কাটাতে পারি, তাহলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হবো। নদীর বাতাস, সাম্পানের দুলুনি আর পাশে তুমি। আমি তো বেশি কিছু চাই না।”
অনিকেত মৃদু হেসে বলেছিল, “তুমি সারাজীবন এমনই সরল আর মিষ্টি থাকবে।”
অনন্যা হেসে তার হাত ধরলো অনিকেতের।
সেদিন শ্রাবণের মায়ায় মোড়া এক অপরাহ্ন। আকাশ কালো আর সাদা মেঘের খেলা দেখছিলো আর বাতাসে ভেসে আসছিলো বৃষ্টির আগমনী সুর। অনিকেত কাজ সেরে ফিরছিলো ঘরে আর অনন্যা অপেক্ষায় ছিলো দরজার ওপারে। দরজা খুলতেই অনিকেত দেখলো তার মুখ, যার ভেতর লুকিয়ে ছিলো এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস।
“আজ কোথাও যেও না, প্লিজ,” অনন্যার কণ্ঠে ছিলো এক গভীর অনুরোধ।
“কেনো? আবার বৃষ্টি হবে বলে?” অনিকেত হেসে জিজ্ঞাসা করলো।
“হ্যাঁ, বৃষ্টি হবে ঠিকই, কিন্তু কারণ সেটা নয়। আমি চাই তুমি আজ শুধু আমার সঙ্গেই থাকো। এই শ্রাবণ, এই সন্ধ্যা, কেবল আমাদের জন্য।”
তার চোখে এমন কিছু ছিলো, যা উপেক্ষা করার উপায় ছিলো না। অনিকেত মৃদু হেসে বললো, “ঠিক আছে, আমি আজ আর কোথাও যাবো না।”
তারা বসেছিলো জানালার পাশে। বাইরে দমকা বাতাসে বৃষ্টির প্রথম ছাঁট এসে জানালার কাঁচে পড়ছিলো টুপটাপ শব্দে। অনন্যা হালকা করে অনিকেতের কাঁধে মাথা রাখলো। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর সে মৃদুস্বরে বললো, “জানো, আমার মনে হয় আজকের এই শ্রাবণ আর আমাদের নিয়ে একটা কবিতা লেখা উচিত। এমন একটা কবিতা, যা শুধু আমাদের হবে।”
অনিকেত তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অনন্যার মুখে এমন এক মুগ্ধতা ছিলো, যা সে আগে কখনো দেখেনি। সে অনন্যার ঠোঁটে এক অমলিন হাসি দেখতে পেলো।
“তোমার এই স্বপ্নগুলোই তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে,” বললো অনিকেত।
“তাহলে আমার স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রেখো,” মৃদু হেসে অনন্যা উত্তর দিলো।
সেই মুহূর্তে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। বিজলির আলোয় ভেসে উঠলো তাদের মুখ। জানালার পাশে বসে থাকা থেকে তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব একসময় মিলিয়ে গেলো।
অনিকেত তাকে টেনে নিলো কাছে। অনন্যা তার শরীর ঘেঁষে বসে বললো, “তুমি কি জানো, তুমি আমার জীবনের শ্রাবণ?”
“তুমি আমার হৃদয়ের বৃষ্টি,” অনিকেত হাসলো, তার কণ্ঠে ছিলো গভীর স্নেহ।
তারা যখন পরস্পরের বাহুডোরে বাঁধা পড়লো, তখন বাইরের শ্রাবণ বৃষ্টির পুঞ্জিভূত মেঘ থেকে অঝোর ধারা নেমে এলো। ঘরভর্তি নিস্তব্ধতার মাঝে কেবল ছিলো দমকা বাতাসের শব্দ আর তাদের দুজনের শরীরের উষ্ণতার বিনিময়।
বৃষ্টি যখন মাটির তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল, অনন্যা আর অনিকেত একে অপরের অস্তিত্বে ডুবে গিয়েছিলো। তাদের মনের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো সেদিন। শরীর আর মনের মিশ্রণে তারা খুঁজে পেয়েছিলো এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
পরে, বৃষ্টির মৃদু শব্দে যখন তারা একে অপরের পাশে শুয়ে ছিলো, অনন্যা চোখ মেলে তাকিয়ে বললো, “আমরা কি ভুল করলাম?”
অনিকেত তার চুলে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বললো, “ভালোবাসায় কোনো ভুল হয় না। এটা আমাদের শ্রাবণের গল্প।”
কিন্তু সেই শ্রাবণ কী শুধুই ছিলো এক মুহূর্তের সুখের স্মৃতি? নাকি ছিলো জীবনের এক গভীর দহন, যা তারা তখনো বুঝতে পারেনি?
বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেকেই চিনতে কষ্ট হলো অনিকেতের; নির্জন পথ ধরে অকারণ হেঁটে গেলো বহুদূর। একবার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কেউ যেনো তাকে প্রশ্ন করছিলো, "অনন্যার কাছে যা কিছু চাওয়ার কিংবা পাওয়ার ছিলো, তার সবই তো পাওয়া হয়ে গেছে। তাকে আর কি প্রয়োজন আমার?"
অনন্যাকে পাওয়ার জন্য সে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে। তার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বুক বেঁধেছে। প্রতিজ্ঞা করেছে তার মাথায় হাত রেখে, "আমি তোমার পাশে থাকবো, সারাজীবন।" অথচ সেদিন হঠাৎ করেই মনে হলো, অনন্যা যেনো অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
অনন্যার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেলো। সে আগের মতো অনন্যাকে আর খেয়াল করতো না; তাকে সব সময় কেমন এড়িয়ে যেতে লাগলো। প্রথম দিকে অনন্যা ভাবতো, হয়তো অনিকেত কাজে ব্যস্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে সে অনিকেতের আচরণের পরিবর্তন টের পেলো। একদিন চুপচাপ বললো, “তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো?”
অনিকেত তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো।
কিছুদিন পর অনন্যা টের পেলো, তার শরীরে নতুন এক প্রাণের স্পন্দন। আনন্দে এবং শঙ্কায় তার মন ভরে উঠলো। একদিন সাহস করে বললো, “অনিকেত, তুমি বাবা হতে চলেছো।”
অনিকেত স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি এই দায়িত্ব নিতে পারবো না। এটা আমার চাওয়া নয়। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।”
শব্দগুলো যেনো তীরের মতো বিঁধলো অনন্যার হৃদয়ে। শীতল হয়ে গেলো তার সারা শরীর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “ভুল? তুমি এখন একে ভুল বলছো? আমার শরীরে মধ্যে বেড়ে উঠছে তোমার যে সন্তান, সেও কি ভুল?” অনিকেত নির্বাক রইলো।
অনন্যা সহজ-সরল মেয়ে হলেও তার ভেতরে ছিলো এক অবিচল শক্তি। কোনো অভিযোগ বা কান্নায় ভেঙে পড়লো না। কেবল চুপচাপ নিজের বেদনা বুকে চেপে রইলো।
নিজেকে বাঁচানোর পথ খুঁজতে অনিকেত সিদ্ধান্ত নিলো, সে পালিয়ে যাবে এমন এক জায়গায়, যেখানে অনন্যার স্মৃতি তার পিছু করবে না। তবে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার আগমুহূর্তে অনন্যা তার পথ আটকাল। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি। তার চোখে ছিলো জল আর মুখে বেদনার মেঘ। কোনো শব্দ ছিলো না, শুধু এক দৃষ্টি, যা হাজারো কথা বলে যাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে অনিকেতের চোখে তাকিয়ে হাত নাড়লো। বিদায় জানালো। সেই বিদায়ের মধ্যে ছিলো এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, যা অনিকেত তখন বুঝতে চাইলো না।
অনিকেত চলে গেলো ঠিকই কিন্তু অনন্যার সেই অশ্রুসিক্ত চোখ আর বেদনাভরা মুখ তার মন থেকে মুছতে পারলো না। বিদেশের রঙিন আলোর ভিড়েও তার দিন কাটতো নির্জনতার ছায়ায়। প্রতিদিন, প্রতিরাতে তার মনের ভেতর ভেসে উঠতো অনন্যার মুখ।
অবশেষে, একদিন নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না। সিদ্ধান্ত নিলো ফিরে আসবে। সেই প্রিয় শহরে, সেই প্রিয় মানুষের কাছে।
কিন্তু ফিরে এসে দেখলো, অনন্যা আর নেই। কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সে। কেউ জানে না, কোথায় গেছে মেয়েটি। অনন্যার ঘর শূন্য, তার অস্তিত্বের চিহ্নও মুছে গেছে।
অনিকেত অনেক খুঁজলো, অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু অনন্যার কোনো খবর পেলো না। শুধু মনটা বলছিলো, অনন্যা তাকে শেষ বিদায় জানাতে যে চোখে তাকিয়েছিলো, সেই দৃষ্টির ভেতর ছিলো এক চিরন্তন ব্যথা। সেই ব্যথা অনিকেতের হৃদয়েও এক গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেলো।
স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরলো। যে অনন্যাকে সে "অপ্রয়োজনীয়" ভেবেছিলো, সেই অনন্যাই তার জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ ছিলো। কিন্তু আজ, সেই মানুষটিকে চাইলেও আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। অনিকেত বুঝলো, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে অনন্যা ছিলো, আছে আর থাকবে—তার অস্তিত্বের গভীরে এক চিরন্তন স্মৃতি হয়ে।
হঠাৎ একদিন একটা চিঠি এলো অনন্যার। সে লিখেছে, “কেনো তুমি এমন করলে - জানতে চাইবো না, অভিযোগও নয়, শুধু একটি কথা জানাতেই লিখছি আজ - এই মুহূর্তে আমার কোলে খেলা করছে তোমার সন্তান, সে তোমার পিতৃ-পরিচয়েই বড় হবে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে; তুমি ভয় পেয়ো না, তোমার পরিচ্ছন্ন জীবনে অবর্জনা হয়ে কখনও আসবো না আমি; তুমি ভালো থেকো।”
চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ার সময় অনিকেতের ভেতরটা যেনো ঝড়ের মতো তোলপাড় করছিলো। প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে অনল জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো। “তুমি ভয় পেয়ো না, তোমার পরিচ্ছন্ন জীবনে অবর্জনা হয়ে কখনও আসবো না আমি; তুমি ভালো থেকো।” এই লাইনগুলো যেনো তাকে শেষ করে দিচ্ছিলো।
জীবন থেমে থাকে না, কিন্তু অনিকেতের সময় যেনো সেদিন থেকে থমকে গেছে। প্রতিটি রাত এখনো জাগা—চোখের সামনে ভেসে ওঠে অনন্যার সেই অশ্রুসিক্ত দুচোখ। তার মনের গভীরে জমে থাকা অনন্যার মায়াবী মুখটা যেনো এক স্থায়ী ক্ষত।
অনিকেত একা বসে ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে একাকী রাতে। চারপাশে যেনো কেবল বিষের বাতাস। বুকের মধ্যে ধিকিধিকি করে জ্বলছিলো এক জীবন্ত অগ্নিগিরি। মনে পড়ছিলো প্রতিটি ভুল, প্রতিটি অবহেলা। অনন্যার সেই অশ্রুসিক্ত চোখ আর মায়াবী মুখটা যেনো তাকে শূন্য থেকে আরো শূন্যে ঠেলে দিচ্ছিলো।
হঠাৎ সে কলম তুলে নিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্যার উদ্দেশে এক চিঠি লিখলো; ঠিক চিঠি নয়, যেনো একটি কবিতা, যেখানে তার সব ব্যথা, অনুশোচনা আর ক্ষমা চাওয়ার আকুতি ঢেলে দিলো:“হ্যাঁ অনন্যা, আমি খুব ভালো আছি,
আমার চারদিকের বাতাসে কেবলই বিষের গন্ধ
বুকের মধ্যে এক জীবন্ত অগ্নিগিরি, অভিশপ্ত অগ্নিকুণ্ড।
গতকাল রাতের মত অসংখ্য রাত আমি কাটিয়েছি নির্ঘুম জেগে,
অসংখ্য দিন নিঃশব্দে দগ্ধ হয়েছি শুধু তোমাকে ভেবে।
শুধু একটি ভুলের জন্য আজ প্রতি মূহুর্তে হৃদয় থেকে
উদ্গিরিত হচ্ছে লাভা, ক্ষরিত হচ্ছে রক্ত।
আর তোমার সেই অশ্রুসিক্ত দুচোখের অদৃশ্য আগুনে
দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত আমার সর্বাঙ্গ।
শুধু একবার তুমি ক্ষমা করো আমায়,
তোমার মমতার শীতল আঁচল দিয়ে শুধু একবার
নিভিয়ে দাও আমার বুকের এই অনল।
একবার তুমি ফিরে এসো অনন্যা, শুধু একবার।
আর কখনও ছেড়ে যাবো না তোমায়, কথা দিচ্ছি।
আমার সন্তান আর তোমাকে সযত্নে আগলে রাখবো
সারা জীবন এই বিদগ্ধ হৃদয়ের মাঝে।”
চিঠিটা শেষ করে অনিকেত চুপচাপ বসে রইলো। জানলার বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছিলো। কোথাও দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি যেনো তার অস্থিরতার প্রতিধ্বনি করছে।
কিন্তু চিঠিটা আর কখনও হয়তো অনন্যার হাতে পৌঁছাবে না। অনিকেতের চোখ ভিজে গেলো। কাঁচের জানলার ওপারে পৃথিবী ঝরঝর করে কাঁদছিলো শ্রাবণের বৃষ্টিতে। সে জানতো, তার ভালোবাসা আজ শুধু একান্ত অনুশোচনার নামান্তর। তবুও সে মনের গভীরে একটা আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলো- যদি কোনো একদিন, কোনো একভাবে, অনন্যা তাকে ক্ষমা করতে পারে।
বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিলো। কিন্তু অনিকেতের হৃদয়ের ঝড় হয়তো থামবে না কখনোই।