রুদ্রশংকর প্রথম যেদিন কাজে যোগ দিল ব্রীজবেন হোটেলে, তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সহকর্মীদের চোখে সে বোকা বলে বিবেচিত হলো। অন্য ডিভিশনের কথা বলতে পারি না, তবে ফ্রন্ট অফিসের কারও কাছেই মনে হলো না, রুদ্রশংকরের মাঝে স্মার্টনেস আছে।
রুদ্রর মুখ খানি হাসোজ্জ্বল, কথা বলে সুন্দর করে ও শুদ্ধ উচ্চারণে, কন্ঠস্বর মসৃন ও মোলায়েম, উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। মহাত্মা গান্ধীর মত হালকা ফ্রেমের গোল চশমা। চুলগুলো সামনে থেকে পিছনের দিকে কাঁধ পর্যন্ত লম্বা এবং উসকো খুসকো ভাবে বিন্যস্ত। সাধারণত হালকা রঙের পাঞ্জাবী বা ফুতুয়ার সাথে পাজামা অথবা জিন্স পড়ে, পায়ে মানানসই স্যান্ডেল। কাঁধে নকশী করা চটের ব্যাগ। সময়ের ব্যাপারে বেশ সচেতন। হাতে অনেকটুকু সময় রেখেই চলে আসে হোটেলে। ড্রেসিং রুমে ঢুকে চুলে জেল মেখে লেপ্টে পিছনের দিকে আঁচড়িয়ে নেয়; তারপর হোটেলের ইউনিফর্ম- সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার, হলুদের মাঝে কালো ডোরা টাই, কালো রঙের প্যান্ট ও জুতা পড়ে আট দশ মিনিট আগে সে উপস্থিতি ঘোষনা করে। তার এ গুনটি অবশ্য স্মার্ট হবার উপয়োগী নয়। এ দেশেতো বোকারাই কেবল সময় মেনে চলে। যাহোক, কাজের প্রতি সে শ্রদ্বাশীল। পরে করার জন্য কাজ ফেলে রাখা তার স্বভাবের বাইরে। সবাই আড়লে আবডালে বলাবলি করতে শুরু করল, রুদ্রশংকর বাইরে যতই স্মার্ট সাজুক, আসলে সে বোকারাম। কিন্তু আমাদের এমডি সাহেব ঠিক বুঝেছিলেন, রুদ্রর মাঝে বারুদ আছে। দু’সপ্তাহ পার না হতেই বলেছিলেন, “হি উইল বিকাম দা বেষ্ট অফ দা ফ্রন্ট অফিস অব দিস হোটেল”।
শুরু থেকেই আমার কৌতুহল ছিলো ওকে জানবার। ওর সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করলাম; বন্ধুত্ব হয়ে গেলো সহজেই। এমবিএ পরীক্ষা শেষ করে পর্যটন কর্পোরেশনে ছয় মাসের ট্রেনিং কোর্স শেষে যোগ দেয় ব্রীজবেন হোটেলে। কাজের প্রতি শ্রদ্ধা আর অগ্রহ থাকার ফলে খুব অল্প সময়েই সব কাজ তার আয়ত্বে এসে গেলো আর সেই সঙ্গে সাঙ্গ হলো তার প্রতি সবার হিংসা বোধ। ব্রিজবেন হোটেলের বিচক্ষণ এমডি সাহেব গোল চশমার ভেতরে রুদ্রশংকরের বুদ্ধিদীপ্ত দু’টি চোখে যে প্রতিভার আগুন দেখেছিলেন সে কি ভুল হতে পারে! মানুষতো শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে যোগ্যতা আর কাজের মাধ্যমে। সময় জ্ঞান যার তীক্ষ্ণ, কাজের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল তার জন্যইতো অপেক্ষা করে শ্রেষ্ঠত্ব। নিজের মেধা, শ্রম ও যোগ্যতার বলেই চাকুরী জীবনের প্রথম বছরেই রুদ্র নির্বাচিত হলো এমপ্লয়ী অব দ্যা ইয়ার।
একদিন রুদ্রকে ধরে নিয়ে এলাম বাসায়। আমার স্ত্রী রত্না প্রথম আলাপনেই রুদ্রকে পছন্দ করে ফেললো এবং ক্রমে ওদের মাঝে গড়ে উঠল নিবিড় বন্ধুত্ব। আমাদের ছেলের প্রথম জন্মদিনে রুদ্র মর্নিং শিফট ডিউটি শেষ করে বাসায় এলো, একটা গিফট নিয়ে। এসেই আমার ছেলেকে আশীর্বাদ করে নিজেই একটা আপেল বের করে খেয়ে নিলো। তারপর রত্নার কাছে গিয়ে হাতজোড় করে বললো, “ক্ষমা প্রার্থনা করছি থাকতে পারছি না বলে। অনেক আশীর্বাদ থাকল ওর জন্য। আগামীকাল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী; অনেক কাজ পড়ে আছে; ইতোমধ্যে ওরা অনেকবার ফোন করেছে। আফ্টার অল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বটা এড়াতে পারি না”।
রত্না একটু রাগের সুরে বললো, “এতো বড় দায়িত্ববান ব্যস্ত লোকের এই অকাজে না এলেইবা কী এমন ক্ষতি হতো?”
রুদ্র হেসে উত্তর দেয়, “কাকে আপনি অকাজ বলছেন ভাবী? আমার আদরের চাচ্চুকে আর্শীবাদ করতে আসা- এ কি কম বড় গুরু দায়িত্ব? পৃথিবীতে যে যত বেশি দায়িত্বশীল তার তত বেশি ব্যস্ততা; অজস্র ব্যস্ততা সত্ত্বেও সে আবার কোন দায়িত্ব এড়াতেও পারে না”।
রত্না আগের মতই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “ব্যস্ততা ফুরালেই না হয় আসা যেতো”।
কথা শেষ হওয়া মাত্রই রত্নার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে হেসে বললো, “না, তা যেতো না। প্রথমত ব্যস্ততা ফুরায় না আর দ্বিতীয়ত সময়ের কাজ সময়ে করাটাই সিন্সিয়ারিটি”।
রত্না এবার হেসে ফেললো, রুদ্রর নাকটা মলে দিয়ে বললো, “খুবতো সিন্সিয়ার; বিয়ের ব্যাপারে সিনসিয়ারিটি কোথায়?”
রুদ্র হেসে জবাব দিল, “সে-ও সময় মতই হবে, সময়তো ফুড়িয়ে যায়নি; না হয় আার একটু অপেক্ষা...”
রত্নার সাথে রুদ্রশংকরের তর্ক বেশ জমে। রত্না যুক্তিবিদ্যার ছাত্রী, যুক্তিতে সেও কম যায় না, তবে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠে না। কিন্তু রুদ্রর একটা দোষ আছে; সব সময় স্টেট ফরওয়ার্ড কথা বলে । অনেকেই এটা পছন্দ করে না। একদিন বোঝাতে চেষ্টা করলাম, এভাবে সরাসরি কথা বললে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। তার সাফ জবাব, “স্পষ্ট কথায় অনেকেই হয়ত রেগে যান কিন্তু এর মধ্যে একটা স্বচ্ছতা আছে। তাছাড়া সত্য ও স্পষ্ট কথার নিজস্ব একটা শক্তিও আছে। উপরন্তু ঈশ্বর আমাকে একটা গুন দিয়েছেন, এ জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ; আমার উপর কেউই বেশিক্ষন রেগে থাকতে পারে না, পেরেছে কেবল একজন; শুধুই একজন”।
আমি একটু রহ্যসের গন্ধ পেয়ে জানতে চাইলাম, “কে সেই একজন?” মুচকী হেসে রুদ্র বললো, “আজ থাক, আরেক দিন হবে সে কথা”।
রুদ্রশংকরের শোবার ঘর যেনো একটা মিনি লাইব্রেরী। বই হচ্ছে ওর নেশার বস্তু। রুদ্রর মত রত্নারও বই পড়ার নেশা। রুদ্রশংকরের সংগ্রহে উপন্যাসগুলো দেখে রত্না মহাখুশি। প্রায়ই বই এনে পড়ে সে। বইয়ের জন্য হলেও ঘনঘন যাওয়া আসার ফলে দুই পরিবারের মাঝে গড়ে উঠলো নিবিড় আত্মীয়তা, এক অদেখা বন্ধন। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই একদিন রুদ্রদের বাসায় গেলাম। যেতে যেতে বৃষ্টি শুরু হলো। ভেতরে ঢুকতেই কানে ভেসে এলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর- “মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে...”
রুদ্র ব্যালকনিতে গ্রীল ধরে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে। রত্না কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কে ভাই এমন করে দ্বিধা নিয়ে চলে গেলো? আমার এই ভালো-মানুষ দেবরটাকে ছেড়ে?”
খুবই স্বাভাবিক ভাবে হেসে জবাব দিলো, “যে যাবার কথা ছিলো না। আর নিশ্চয়ই ভালো মানুষ ভাবতে পারেনি; হয়ত চলে যাবার কালে মনে একটা খটকাও লেগেছিলো, তাই দ্বিধা নিয়ে একবার ফিরে তাকাল”।
- আমি তার কথাই জানতে চাচ্ছি।
- সেটা কি খুবই জরুরী, ভাবী?
- অবশ্যই জরুরী। তোমার হৃদয় বীনায় যে বিরহের সুর বাজছে, এটা কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই।
রুদ্র কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসলো শুধু। হাসির ভাবটা এমন- রত্নার মিথ্যে বলাটা চমৎকার হয়েছে। হাসির অর্থ রত্নার কাছেও বোধগম্য, তাই আরেকটু পোক্ত করার জন্য বললো, “দ্যাখো রুদ্র, হাজার হাজার বইপড়া বিদ্যে নিয়ে মানুষ চেনার চেষ্টা করো তুমি। কিন্তু মেয়েদের ওসব বিদ্যে টিদ্যে দরকার হয় না। চোখ দেখেই চিনতে পারে”।
মার কোলে অনেক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে; শুইয়ে দিলাম। ততক্ষনে চা চলে এলো। রুদ্র একটা বড় সাইজের এলবাম এনে সামনে রাখলো। বাইরে বর্ষণ তখনও থামেনি, বাতাস থেমে গেছে। রুদ্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো, “এই এলবামে তার দুটো ছবি আছে। এটা তারই দেয়া। বলেছিলো, বিয়ের ছবি রাখবে এতে। তাই পুরোটাই খালি পড়ে আছে। আছে শুধু এলবামের সাথে দেয়া ওর দুটো ছবি”।
ছবি দুটো প্রথম পাতাতেই পেষ্ট করা। দু’ছবির মাঝে ফাঁকা জায়গায় কিছুটা উপরের দিকে ছবির মাপের একটা সাদা কাগজ পেষ্ট করা। সেটাতে ছোট করে লেখা অপূর্ণতা। রত্না মিষ্টি হেসে বললো, “খুব সুন্দরীতো, হাসিটা কি কিউট, দেখেছে?” আমার দিকে এগিয়ে দিল এলবামটা। তারপর রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আবার বললো, “অবশ্য তোমার পছন্দতো আর খারাপ হতে পারে না! তা, ওর নাম বুঝি অপূর্ণতা?”
রুদ্র শব্দ করে হেসে বললো, “ওটা আমার দেয়া নাম; আসল নাম বিনীতা, বিনীতা ব্যানার্জি। ও হচ্ছে আমার জীবনের একমাত্র অপূর্ণতা।”
রুদ্র কথা শেষ হবার আগেই রত্না প্রশ্ন করল, “বিয়ে হয়েছে কতদিন?”
- এখনও হয়নি।
- বিয়ে হয়নি! তাহলে আগেই উপসংহার পেলে কোথায়? একটু খুলে বলতো।
শুরুটা বাগেরহাটে। বিনীতারা তখন রুদ্রদের বাসার নীচতলায় ভাড়া থাকত। আসলে ওরা শৈশব ও কৌশোরের খেলার সাথী; একসাথে বড় হয়েছে একই পরিবেশে, একই আলো-ছায়ায়। স্কুলে যেতো এক সাথে, খেলতো একসাথে, একসাথেই বেড়াতো, হাসতো, গাইতো...। অনেকটা হঠাৎ করেই রুদ্রদের পরিবার ঢাকায় চলে এলো। দুই বন্ধু চলে গেলো দুই প্রান্তে, মাঝে পড়ে রইল লম্বা পথের দূরত্ব। কলেজের পাঠ চুকিয়ে রুদ্র যে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি হলো, তার পরের বছরই বিনীতার বাবা বদলী হয়ে আসেন ঢাকাতে। ক’মাস পরই বিনীতা ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু হলো এক সাথে ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা, বেড়ানো, আড্ডা ইত্যাদি। নতুন করে আবার প্রানবন্ত হয়ে উঠল ছোট বেলার বন্ধুত্ব।
বিনীতার ছিলো কনসার্ট দেখার প্রচন্ড শখ। রুদ্রর কাছে তা ছিলো বিরক্তকর। এক কনসার্ট থেকে ফেয়ার পথে হঠাৎ একদিন বন্ধুত্বের সবুজ ক্ষেতে উড়ে এলো ভালোবাসার বলাকা। সেদিন মেঘ জমেছিলো আকাশে। ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাষ দিয়েছিলো আবহাওয়া অফিস। রুদ্র চেয়েছিলো টিকিট বেঁচে দিতে; ক্রেতাও পেয়েছিলো। কিন্তু রুদ্রর কথা টিকল না।
কনসার্ট শেষে বের হয়েই দেখল প্রবল বর্ষণ। ঝড়ে থেমে গেলেও রেশ রয়ে গেছে। আধা ঘন্টা অপেক্ষার পরও কোন অটোরিক্সা বা ট্যাক্সি ধরা গেলো না। তিন গুণ ভাড়ায় পাওয়া গেলো এক নড়বড়ে রিক্সা। রুদ্রর রাগের পরিমানটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো বিনীতা। বারবার কিছু বলতে চেষ্টা করেও বলতে পারল না। টানা বৃষ্টির কারণে পানি জমেছে রাস্তায়। নিজেদের গলির মুখে ঢোকার আগেই পানির নিচে ডুবে থাকা ম্যানহোলে পড়ে বেঁকে গেলো রিক্সার চাকা। রুদ্র লাফিয়ে নেমে হাঁটু পানি ভেঙে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে শুরু করল বাসার দিকে। বিনীতা ভাড়া মিটিয়ে রুদ্রর পিছু ছুটল। আশা করেছিলো, তাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কিন্তু নিজেদের বাসার গেটে ঢুকল রুদ্র।
আর বিনীতা তখনই দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো রুদ্রর সামনে। মুখটা নিচু করে কাতর কন্ঠে বললো, “সরি, রুদ্র। ভেরি ভেরি সরি”। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। আবেগে আপ্লুত হয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বললো, “রাগ কোরো না, প্লীজ। আর কখনও এমনটি হবে না। তুমি রাগ করলে আমার পৃথিবীটা পায়ের নিচ থেকে সরে যায়”। তারপর আর রুদ্র রাগ করে থাকেনি। চোখের জল মুছে আদর এঁকে দিয়েছে বিনীতার কপালে। রাগ ভুলে, অভিমান ভুলে ভালোবাসার উষ্ণতায় বৃষ্টিভেজা দুটি প্রাণী যেনো মিলে মিশে এক হয়ে গেলো।
এরপর গল্প-কথায়, ভালোবাসায় কেটে গেলো কয়েকটি বছর। এমবিএ ফাইনাল শুরু হবার আগের দিন সন্ধ্যায রুদ্র যখন সবে মন দিয়েছে পড়ায়, তখন হঠাৎ এসে উপস্থিত হলো বিনীতা। তার সাথে দু’ঘন্টার জন্য বেরুতে হবে বলে জেদ ধরল। পরীক্ষার আগে সাধারণত সে আসে না। কিন্তু সেদিন কেনো যেনো জেদ ধরে বসল।
রুদ্রর রিভিশনের তখনও অনেকটা বাকি, বিনীতাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কিছুতেই বোঝানো গেলো না। অবশেষে রুদ্রও হারিয়ে ফেলল তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ। অনেকটা রুক্ষ ভাবেই বলে উঠল, “দেখ বিনীতা তোমার চাইতে এখন পরীক্ষা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ন”।
বিনীতাও চটে গিয়ে চিত্তেজিত ভাবে বললো, “ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি; একেবারে সরে যাচ্ছি তোমার জীবন থেকে। আর কখনও আসবো না তোমাকে বিরক্ত করতে। আর আমাকে বিরক্ত করতে যদি না যাও তাহলে আমিও খুশি হবো।” কথা গুলো বলেই চলে গেলো সে দ্রুত পায়ে। দরজার কাছে গিয়ে একটু খানি থেমে বিনীতা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, “তবে পরীক্ষায় তোমার সাফল্যই প্রার্থনা করব ঈশ্বরের কাছে। ভালো থেকো।”
ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। অদূরে এক বাড়ির কার্নিশে বৃষ্টিভেজা একটা পাখি; রুদ্রর দৃষ্টি সেই পাখির দিকে। রত্না বললো, “না হয় রাগের মাথায় সে ওভাবে চলেই গেছে সেদিন, কিন্তু তোমার তো উচিৎ ছিলো পরে তার মান ভাঙানোর।”
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “চেষ্ট করেছি, ফল হয়নি। আসলে ও-যে এতো বেশি রাগ করেছে, বুঝতেই পারিনি। পরীক্ষা শেষ হবার পরে বেড়াতে যাবো ভেবে ফোন করে যেদিন বলতে গেলাম সেদিনই বুঝলাম। স্মরন করিয়ে দিলো, ওকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিলো।”
রত্না হঠাৎ বিনীতার ফোন নম্বর চাইল। রুদ্র একটু চুপ থেকে বললো, “ফোন নম্বর দিতে কোন আপওি নেই। তবে যে উদ্দেশ্যে ফোন করার কথা ভাবছেন, সেটা ঠিক হবে না। আমি অনেক করে বুঝিয়েছি, দুঃখ প্রকাশ করেছি; ফল হয়নি। অবশেষে বলেছি, কোনদিন ফিরে আসতে ইচ্ছা হলে যেনো দ্বিধা না করে চলে আসে; আমি সেই মুহূর্তেটার অপেক্ষায় থাকব।”
আমি প্রশ্ন করলাম, “নিঃসঙ্গ মুহূর্তে ওর কথা মনে হলে কষ্ট হয় না?”
জবাব এলো হাসিমুখেই, “মোটেই না। এ ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব একটা দর্শন আছে। নিজের ব্যর্থতার কারণে যদি হারাতাম, তাহলে হয়তো অনেক বেশি কষ্ট হতো। পূর্ন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত না হলে সান্ত্বনা এই যে, নিজেরতো কোন দুর্বলতা বা ত্রুটি ছিলো না। হ্যাঁ, এটা ঠিক, মাঝে মাঝে খুব মিস করি”। আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো রুদ্র।
রত্না কিছু সময় কি যেনো ভাবলো, তারপর প্রশ্ন করলো, “বিনীতা যদি আর ফিরে না আসে, তাহলে তুমি কি করবে? চিরকুমার থেকে যাবে?” প্রশ্নটা করেই রত্না হেসে উঠলো।
রুদ্র খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো, “মানুষ চায় তার অপূণর্তাকে যে কোনো উপায়ে পূর্ণতা দিতে। তাছাড়া আমার মা-বাবা আমাকে নিয়ে যে স্বপ্নের প্রাসাদ গড়েছেন সে প্রাসাদের কোথাও এতোটুকু আঁচড় লাগুক, সেটা চাইতে পারবো না। তবে আমার বিশ্বাস, বিনীতা একদিন ফিরে আসবেই। আমার উপরে কেউ রাগ করে থাকতে পারে না, বিনীতা ও পারবে না”।
রুদ্র ভীষন আত্মবিশ্বাসী, সন্দেহ নেই। আমি অবশ্য এ ব্যাপারে সন্দিহান; দীর্ঘ বিচ্ছেদ প্রেমকে হত্যাও করে। বিনীতা যদি ফিরেই আসবে, তাহলে এতো দিন এভাবে দূরে কেনো থাকবে? ভালোবাসার ক্ষেত্রে পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাসবোধই বড় বিষয়। বিনীতা কি পারে না কোন একটা অযুহাতে আবার নুতন করে শুরু করতে! রত্নার ধারনা, নিজের উপরে এবং ভালোবাসার উপরে যার এতো আস্থা, তার ভালোবাসার মানুষটি ফিরে না এসে পারেই না!