মাধবী। নামটির মতোই মিষ্টি মেয়েটি। রূপে-গুণে সে সত্যিই অপরূপা। মেঘের মতো কালো, কোমর ছাড়ানো তার দীঘল চুল। কাজলকালো গভীর দুই চোখে যেনো দূর আকাশের অসীমতা খেলা করে, স্বপ্ন যেনো সেখানে বাসা বেঁধেছে। শান্ত, স্নিগ্ধ এক চাহনি, যে চাহনিতে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের অপার হাতছানি।
মাধবীর কপালখানি চাঁদের মতো গোল, কোনো ভাঁজ নেই, যেনো এক টুকরো মসৃণ, লাবণ্যময় পাথর। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। গ্রামের সবাই বলতো, ‘মেয়েটা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। কপাল দেখেই বোঝা যায় কতো সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে।’ হয়তো তাই ছিলো। মাধবীর জীবনে বসন্তের ছোঁয়া লাগে যখন সে একুশে পা দেয়।
এক শরৎকালে, জ্যোৎস্নারাতে, যেনো আকাশ থেকে এক ঝাঁক জোনাকি নেমে এসেছিলো মর্ত্যে, ঠিক তেমনই এক মায়াবী পরিবেশে মালাবদল হলো মাধবীর। বরের মুখটি স্পষ্ট মনে নেই, শুধু মনে আছে এক অপার্থিব আলো, আর হৃদয়ে এক নতুন অনুভূতির শিহরণ।
বিয়ের প্রথম রাতের কথা মনে পড়লে আজও মাধবীর সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। সবকিছু যেনো স্বপ্নের মতো ছিলো। চারিপাশের মৃদু আলো, ফুলের সুবাস, আর সেই নতুন মানুষটির স্পর্শ—সব মিলিয়ে এক ঘোরলাগা পরিবেশ। মাধবীর মনে হচ্ছিলো যেনো সে কোনো স্বপ্ন দেখছে, অথবা হয়তো মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু এই ঘোর, এই স্বপ্ন কতোদিন টিকবে, তা কে জানতো? সময়ের স্রোতে মাধবীর জীবনেও যে কতো ঝড় লুকিয়ে ছিলো, তা সেই রাতে কেউ কল্পনাও করতে পারতো না।
একটি বছরও কাটলো না। মাধবীর ভরা সংসার, রঙিন স্বপ্ন—সব যেনো এক লহমায় ধুলিসাৎ হয়ে গেলো। একদিন, শহরের ব্যস্ত রাজপথে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। যেনো সাক্ষাৎ কালবৈশাখী ঝড়, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিলো। মাধবীর হাসিখুশি পৃথিবী মুহূর্তে অন্ধকারে ঢেকে গেলো।
দুর্ঘটনার খবর যখন এলো, মাধবীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে তার সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলো, হাতের শাঁখা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো, কপাল যেনো পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। তার স্বপ্নের ঘুড়িগুলো, যা সে এতো যত্ন করে বুনেছিলো, সব যেনো হৃদয়ের উপত্যকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ভেঙে পড়লো।
তারপর শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়—অন্ধকার, নিষ্ঠুর এক অধ্যায়। 'অলক্ষ্মী', 'অপয়া'—এমন হাজারো অপবাদ এসে বিঁধতে লাগলো মাধবীর বুকে। সমাজের চোখে সে যেনো এক বোঝা, এক অভিশাপ। অবহেলা, অনাদর, অসম্মান—সব মিলিয়ে অপরূপা মাধবী যেনো এক জীবন্ত লাশে পরিণত হলো।
অকাল বৈধব্যের অভিশাপ তার স্নিগ্ধ রূপকে মলিন করে দিলো, সাদা থান আর লালিত্যময় শরীর যেনো তার কষ্টের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলো। কিন্তু মাধবী হার মানলো না। পাথর-কঠিন মনে, সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে, সে এক কঠিন পথে অবিচল হেঁটে চললো। তার চোখেমুখে এক দৃঢ় সংকল্প, যেনো সে প্রমাণ করতে চায়—বিধাতা যা কেড়ে নিয়েছেন, তার থেকেও বেশি শক্তি তার মধ্যে সঞ্চিত আছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যেও মাধবীর ভেতরের আগুন নেভেনি, বরং আরও তীব্র হয়েছে।
মাধবীর জীবনে যখন সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, যখন চারিপাশের অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিলো, ঠিক তখনই যেনো এক দমকা হাওয়া এসে লাগলো। অকস্মাৎ, এক অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে, এক সাহসী রাজপুত্র—যেনো রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোনো নায়ক—সমাজের সমস্ত নিষেধের প্রাচীর ভেঙে, মাধবীর মনের চোরাগলি পথে প্রবেশ করলো।
আবার স্বপ্ন দেখার সাহস পেলো মাধবী। তার মনে আবারও ফুল ফুটলো, যেনো বহুদিন পর শুকনো নদীতে বান এলো। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়তে লাগলো তার হৃদয়ের আকাশে। এক নতুন আশার আলো ঝলমল করে উঠলো তার চোখেমুখে।
কিন্তু সমাজের চোখ তো সবকিছু দেখে। তাদের দৃষ্টি এড়ালো না মাধবীর এই পরিবর্তন। তখনই যেনো সমাজপতিরা নড়েচড়ে বসলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম, সেই পাঁচুলাল, যে মাত্র দু’মাস আগেই নিজের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর এক মাস না যেতেই, তার মেয়ের বয়সী এক কিশোরীকে বিয়ে করেছে, সে-ও যেনো নীতিবাক্য শেখাতে এলো। গলায় পৈতে জড়িয়ে, পানের পিকে মুখ ভর্তি করে, আঙুল ঘষতে ঘষতে সে বলে উঠলো, “বিধবা বেওয়ার বিয়ে! তাও অবিবাহিত ছেলের সাথে! ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা কোনো ধর্মে, কোনো কালে শুনিনি!”
পাঁচুলালের এই কথা যেনো আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। সমাজের তথাকথিত রক্ষকেরা যেনো একযোগে মাধবীর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হলো। তাদের চোখে মাধবীর এই নতুন করে বাঁচতে চাওয়া যেনো এক মহাপাপ। কিন্তু মাধবী, সে যেনো এক অন্য ধাতুতে গড়া। সমাজের এই ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে, সে তার নতুন পথের দিকে আরও দৃঢ়ভাবে পা বাড়ালো। তার মনে এখন একটাই সংকল্প—নিজের মতো করে বাঁচা, নিজের শর্তে বাঁচা।
মাধবী চুপ করে সব শুনছিলো। তার চোখেমুখে কোনো উত্তেজনার চিহ্ন নেই, বরং এক গভীর বেদনা আর দৃঢ়তা খেলা করছিলো। দীর্ঘ সময় নীরব থাকার পর, এক নিমগ্ন স্বরে সে কথা বলতে শুরু করলো—যেনো তার ভেতরের জমে থাকা ক্ষোভ, অভিমান আর যন্ত্রণা আজ মুখ খুলে বেরোতে চাইছে।
“এই সমাজের একজন পুরুষ কি কখনও এই নিঃসঙ্গ জীবনের ভার বয়ে দেখেছেন?” মাধবী প্রশ্ন করলো, তার কণ্ঠস্বরে যেনো এক অব্যক্ত কষ্ট। “দেখেননি। বরং, যে বুড়োটির স্ত্রী মারা গেছে, তার শ্মশানের আগুন নিভে যাবার আগেই সে ঘরে এনেছে কুমারী কোনো মেয়েকে। তখন সমাজের কোনো নীতিবাক্য মনে থাকে না। তখন সব যেনো স্বাভাবিক, সব যেনো মেনে নেবার মতো।”
মাধবী আরও বললো, “আপনারা কখনও অনুভব করেছেন, একজন বিধবার দিন কী নিদারুণ কষ্ট আর অবহেলায় কাটে? করেননি। আপনারা শুধু সনাতনী নিয়মের দোহাই দিয়ে সমাজের মাথা খেয়েছেন, আর সুযোগ পেলেই বিধবার ঘরের পাশে গিয়ে কেউটের মতো ফণা তুলেছেন অন্ধকারে! তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন, তাদের একাকীত্বের সুযোগ নিয়েছেন।”
মাধবীর কথাগুলো যেনো তীরের মতো বিঁধলো সমাজের তথাকথিত রক্ষকদের বুকে। তাদের মুখে কোনো উত্তর নেই। মাধবী আরও জোরালো কণ্ঠে বললো, “বিপত্নীকের বিয়ে যদি আপনারা সমর্থন করেন, তাহলে বিধবার বিয়েতে বাধা দিতে আসবেন না কোনোদিন। যদি পুরুষের দ্বিতীয়বার বিয়ে করা স্বাভাবিক হয়, তাহলে নারীর ক্ষেত্রে কেনো নয়? আপনারা যদি নিজেদের বেলায় ছাড় দিতে পারেন, তাহলে আমাদের বেলায় কেনো এতো কঠোরতা?”
মাধবীর এই স্পষ্ট এবং সাহসী কথা যেনো এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো। তার প্রশ্নগুলো সমাজের বুকে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলো, যা সহজে ভোলার নয়। তার এই প্রতিবাদ যেনো আরও অনেক নারীর মনে সাহস জোগালো, যারা এতদিন নীরবে সমাজের অবিচার সহ্য করে আসছিলো।
মাধবীর জোরালো কণ্ঠস্বর আর যুক্তির সামনে সমাজপতিরা যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তাদের মুখে কোনো কথা নেই, শুধু নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। এতোদিন ধরে তারা যে বিচারের আসনে বসে অন্যদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতেন, আজ সেই বিচার যেনো তাদের নিজেদের ওপরই এসে পড়েছে। বিবেকের পিঠে যেনো এক বিষাক্ত চাবুক পড়লো, তাদের এতোদিনের অন্ধ বিশ্বাস আর গোঁড়ামি যেনো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো।
মাধবী তাদের দিকে আর ফিরেও তাকালো না। প্রচলিত নিয়মের অলঙ্ঘ্য দেয়াল ভেঙে, দৃপ্ত ভঙ্গিমায় সে হেঁটে চললো এক নতুন দিগন্তের দিকে—যেনো এক পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সে উড়ে চলেছে স্বপ্নের ঠিকানায়। তার চলার পথে কোনো দ্বিধা নেই, কোনো ভয় নেই, শুধু এক অদম্য সাহস আর আত্মবিশ্বাস।
তখনও মাধবী অপরূপা—মাথায় তার সেই মেঘ-রঙা দীঘল চুল, আর চোখে সেই সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন, যা কোনো প্রতিকূলতাই কেড়ে নিতে পারেনি। বরং, এই কঠিন পথ তাকে আরও শক্তিশালী, আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। তার চোখে এখন শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সমাজের সেই সকল নারীদের জন্য স্বপ্ন, যারা আজও অন্ধকারে বন্দী, যারা আজও সমাজের অবিচারের শিকার। মাধবী যেনো তাদের প্রতিনিধি, তাদের মুক্তির দূত।
মাধবীর এই যাত্রা শুধু তার নিজের জীবনের পরিবর্তন নয়, বরং সমাজের চিন্তাভাবনারও এক বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। তার সাহসিকতা অনেককে নতুন করে ভাবতে শেখায়, প্রচলিত রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শেখায়। এভাবেই, এক সাধারণ মেয়ে থেকে মাধবী হয়ে ওঠে এক অসাধারণ অনুপ্রেরণা, এক নতুন যুগের সূচনা।