BD Trade Blogs
> Blogs > গল্প ও ছোট গল্প > ভালোবাসার চন্দ্রমল্লিকা

ভালোবাসার চন্দ্রমল্লিকা


অসীম তরফদার

শাড়ীর দামটা চুকিয়েই ঝটপট একটা বেবী ট্যাক্সী ডেকে উঠে পড়লাম। বেনুদি বেলা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করে এতক্ষণে নিশ্চয়ই কান্না শুরু করেছে! 

সম্ভাব্য পরিস্থিতি মনে মনে কল্পনা করে বাসায় ঢুকলাম এবং কল্পিত ঘটনাই যখন ঘটতে চলল, তখন একটু কৌশলী হয়ে বললাম, “আজ তোমার এখানে থেকে যাবো। সে জন্যই সব গুছিয়ে রওনা হতে খানিকটা দেরী হয়ে গেলো”। ব্যাস; বেনুদি যেনো অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গেলো! এ যাবত বেড়াতে এসে কখনও রাতে থাকিনি।

আজ রাখী পূর্ণিমা। বাংলার প্রত্যেক দিদি বা বোনেরা তার দাদা ও ভাইয়ের আয়ুবৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনায় হাতে রাখী বেঁধে দেয়। প্রতি বছরের মতো আজও উপোস থেকে পূজো দিয়ে বেণুদি আমার হাতে রাখী বেঁধে দিলো।

আমার পিসতুতো বোন, বেনুদি, দারুন সুন্দরী! একবার দেখলে দ্বিতীবার ফিরে তাকাতে ইচ্ছা হয় প্রায় সবারই। চুলগুলো নদীর ছোটো ছোটো ঢেউযে মতো নেমে গেছে নিচ দিকে, কালো-পুরু ভ্রু-যুগলের নীচে ডাগর ডাগর একজোড়া চঞ্চল চোখ কি যেনো খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার গোলাপী ঠোঁট ফর্সা মুখের উপর এমনভাবে ফুটে আছে যেন পদ্মফুল তার পাপড়ি মেলে ধরেছে। হাসলে তার দাঁতগুলো মুক্তোর মতো চকচক করে, ঠিক যেমন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে দেখা যায়। তার লম্বা ও সুন্দর গড়ন যে কাউকে মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।

এক কথায় ঈশ্বর বেনুদিকে পূর্ণ করেই দিয়েছেন। কেবল স্বরস্বতী দেবীই কিছুটা কার্পুণ্য করেছেন হয়তোবা। তবে প্রচুর সৌভাগ্য ধারণ করার জন্য আছে তার প্রশস্ত ললাট। কলেজে ভর্তি হবার পরপরই প্রজাপতির শুভদৃষ্টি অর্পিত হলো তার উপর। বৈদিক মন্ত্রোচ্চারনের মাধ্যমে গৃহিণী রূপে অধিষ্ঠিত হলো নিখিলেশ চক্রবর্তীর ঘরে।

চক্রবর্তী মশাই একটি সরকারী কলেজের প্রভাষক। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রং, সুন্দর চেহারা, গোল-গাল দেহ, তবে উচ্চতা বেনুদির থেকে বড়জোড় ইঞ্চি দেড়েক বেশী। মেজাজ শান্ত ও ঠান্ডা; কথাও বলেন ধীরে ধীরে আর স্পষ্ট করে। বেনুদির শ্বাশুড়ীটিও বড় ভালো মানুষ। দেখলেই বোঝা যায়, এক সময় তিনি সাংঘাতিক রূপবতী ছিলেন। আজ বার্ধক্যের কারণে কেবল সেই রূপ অনেকটা মলিন হয়েছে। প্রয়াত শশুড়ও ছিলেন যেমন সুদর্শন তেমনিই চমৎকার স্বভাবের। তিনি ছিলেন সেই সময়ের নামকরা ব্যারিষ্টার। তাঁর রুচির পরিচয় পাওয়া যায় এই চোখধাঁধানো বাড়িটি দেখলেই। পাঁচ কাঠা জমির উপর নির্মিত দোতলা অট্টালিকা এবং তার অভ্যন্তরের প্রতিটি আসবাবপত্রে রুচির এক আভিজাত্য ছড়িয়ে আছে।

নিখিলেশ চক্রবর্তী যতটা সময় বাসায় থাকেন ততটা সময়ই বেনুদির সঙ্গ তার চাই। একটু সময়ের জন্যও যেন চোখের আড়াল করতে রাজী নন। সারাক্ষণ পিটপিট করে কথা বলেন। কথায় কথায় একবার বেনুদিকে বলেই ফেললাম, তোমার স্বামী দেবতাটিকে তো বেশ বশ করেছো দেখছি। তোমার আঁচল যেনো ছাড়তেই চায় না। অবশ্য তুমিও কম যাওনা কোনো অংশেই। হান্ড্রেট পার্সেন্ট স্বামী সোহাগিনী।

বেনুদির হাতে একটা পেয়ারা ছিলো, সেটা এসে আঘাত করলো আমার পিঠে আর সহাস্য কন্ঠে ধ্বনিত হলো, “যাহ! ফাজিল কোথাকার! বিয়ে করে নে, তখন দেখবো।”

আমি বললাম, “আমার আবার কি দেখবে বেনুদি? আমারতো কারো সাথেই বনে না, বউয়ের সাথেও বনিবনা হবে না; হবার কথাই নয়।

বেনুদি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “আচ্ছা, আচ্ছা। সময় আসুক তো!”

বিকেলে বেনুদির সাথে ছাদে উঠলাম। বেণুদি হঠাৎ খেয়াল করলো তার চন্দ্রমলি­কা গাছে ফুল ফুটেছে। বেনুদির বহু দিনের সাধনা আজ সফল হলো; অনেক আকাঙ্ক্ষার চন্দ্রমলি­কা ফুটলো প্রথম বারের মতো। আনন্দ আর কে দেখে! দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে দোতলায় এসে ওর শ্বাশুড়িকে ধরে আনলো। বাদ গেলো না তার স্বামীও। আরেক দৌড়ে এসে হাতে নিলো আলতার বোতল এবং পরিশেষে সোজা নেমে গেলো নীচে।

বেনুদি যখন দ্রুত পায়ে একটার পর একটা সিড়ি ভেঙ্গে চলছিলো আমার মনে হলো, যেনো সিঁড়িগুলি ভয়ে বিপর্যস্ত হয়ে থর থর করে কাঁপছে। এবার ওর আনন্দের শিকার হলো ধবধবে সাদা দুটি বাচ্চা খরগোশ। আলতা দিয়ে ওদের স্নান করালো। দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পূত্রবধূর এমন ছেলেমানুষী কান্ড দেখে ওর শাশুড়ি হাসতে হাসতে বেনুদিকে বললেন, “দেখো বৌমা, তোমার ঐ চন্দ্রমলি­কায় ফুল ফুটেছে, ভালো কথা; তাতে খুশী হলেই চলবে? ওসবে আমার পোষাবে না, আমার একটা দাদু-ভাই চাই ।”

বেনুদি কোনো কথা না বলে শুধু হাসলো, আর খরগোশের বাচ্চা দুটিও বেনুদির হাত থেকে মুক্ত হয়ে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। 

বেনুদির সাধের চন্দ্রমলি­কায় আজ ফুল ফুটেছে। বেনুদির শ্বাশুড়ী চাইছেন তার বংশের ফুল ফোটাতে। জীবনের সার্থকতা মানেই তাহলে ফুল ফোটা! তাই বুঝি মানব জীবনের সাধনাকে তুলনা করা হয় বৃক্ষের ফুল ফোটানোর সৌন্দর্য্যরে সঙ্গে!

বেনুদি যখন রাতের বেলায় রান্না ঘরে, তখন ওর শাশুড়ি আমাকে তার ঘরে ডাকলেন। বেতের চেয়ারে বসলাম দুজন। তিনি বললেন, “ঠাকুরের কাছে আমি যেমনটি চেয়েছি, ঠিক তেমনটি পেয়েছি। মনে মনে চেয়েছিলাম, আমার খোকার বউ হয়ে যে আসবে, সে যেনো হাসি আনন্দে উচ্ছলাতায় আমার ঘর মাতিয়ে রাখে। তোমার বোনটি এসে আমার স্বপ্ন সাধ পূর্ন করে দিলো। কি কপাল ভাবো, বাছা! বউমা সারাদিন হাসি খুশী থাকে, দূরন্তপনা করে, কখনও একটু মুখ ভার করে থাকে না; আমার যে কি ভালো লাগে! মনে হয়, আমার ঘরে যেনো স্বর্গ নেমে এসেছে। এ আমার বড় ভাগ্য।”

বৃদ্ধার চোখের কোল ভিজে গেলো। আমি যথোচিৎ গাম্ভীর্য রেখেই বললাম, “তা বৈকি। ভাগ্যতো বটেই। আমাদেরও কি কম সৌভাগ্য? বেনুদিকে এমন একটি ঘরে বিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা কি কম সৌভাগ্যের জোরে”!

রাতে খাওয়ার পর আমি আবার ছাদে গেলাম। ফাল্গুনের রাত তখন পূর্ণচাঁদের আলোয় থৈথৈ। ওপাশের নারিকেল গাছটার লম্বা পাতা সে আলোয় চিকচিক করছে। ছাদের পূর্বদিকে মাঝামাঝি জায়গায় সেই চন্দ্রমলি­কার সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই গাছটা দিয়েছিলেন বিশুদা। বেনুদি অবশ্য আজও তা জানে না। বিশুদা নিজেই জানাতে নিষেধ করেছিলেন। 

বিশুদার বাসা আমাদের পড়াতেই। খুব ভালো ছাত্র ছিলেন বিশুদা। প্রথম বারের চেষ্টাতেই সিএ প্রথম পর্ব পাস করেছেন। দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষাও দিয়েছেন, পাস করে যাবেন নিশ্চিত। শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক অবস্থান এবং সর্বোপরি বিশুদার সুদর্শন চেহারা, স্মার্টনেস ও ব্যক্তিত্ত্ব বিবেচনায় নিলে কোনো ভাবেই  বেনুদির অযোগ্য নন। নিজের ভালোবাসার কথাটা একবার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন বিশুদা। সে ইঙ্গিত যথেষ্ট স্পষ্ট না হবার কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে, অপর পক্ষ থেকে কোনো সারা মিলেনি। 

বেনুদিকে অবশ্য অনেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু বেনুদির স্বভাবের মেয়েরা নাকি সহজেই কারো প্রেমে পড়ে না। ওরা হাসি-খুশীতে আর আমোদ-উল্লাসে মুখর করে রাখে নিজেকে; বাঁধনে জড়াতে চায় না সহজে। তবে ওরা একবার প্রেমে পরলে তার জন্য নাকি জীবন দিতেও দ্বিধা করে না। একবার যাকে মন দেয় তাকে দেবার মতোই দেয়; নিজের সবটুকু উজাড় করে, পরিপূর্ণ করে। কথাটা বিশুদার; হয়তো সত্যিই হবে। 

বিশুদা আমার সিনিয়র হলেও তার সাথে আমার বেশ ভাব। বছর খানেক আগে, এমনই এক ফাল্গুনের রাতে, তিনি সব বলেছিলেন আমাকে। তাদের বাসার ছাদে মুখোমুখী বসেছিলাম আমরা। আকাশে চাঁদ ছিলো, দু-চার টুকরা মেঘও ছিলো। বিছিন্ন-ইতস্তত। দূর থেকে ছুটে আসছিলো শীতল বাতাস। সেদিন আমি তার মুখ আর চোখের ভাষায় হৃদয়ের কথা যতটা স্পষ্ট বুঝেছি, সার্জারী করে তার হৃদপিন্ডটা আমার চোখের সামনে মেলে ধরলেও এতটা ভালো ভাবে বুঝতাম কিনা সন্দেহ।

বিশুদার জন্য আমার কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু করার ছিলো না কিছুই। কারণ কয়েক মাস আগেই বেনুদি যে বউ হয়ে এ বাড়িতে চলে এসেছে। বেনুদি ভালো বর পেয়েছে, ঘর পেয়েছে, সব মিলিয়ে ভীষণ ভালো আছে, এটা জেনে বিশুদা অনেক খুশি! সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়- নিজে আপন করে না পেলেও ভালোবাসার মানুষটি ভালো থাকলে, সুখে থাকলে নিজেকে সুখী মনে করে! সেদিন বিশুদা আমার থেকেই জেনেছিলো, বেনুদির সবচেয়ে পছন্দের ফুল চন্দ্রমলি­কা। 

হঠাৎ একদিন বিশুদা আমাকে বাসায় ডেকে নিলেন। আমার হাতে তুলে দিলেন স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো একটা চারকোনা কাঠের টব, বাইরের দিকটা পিতল দিয়ে মোড়ানো, আর টবের ভিতর একটা চন্দ্রমলি­কার চারা। অনুরোধ জানালেন, দাতার পরিচয় চিরদিনের জন্য গোপন রেখে বেনুদিকে পৌঁছে দেবার। 

আমি বেনুদিকে আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবেই দিয়েছিলাম। আসলে এটা যে বিশুদার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার এক গোপন স্মৃতিচিহ্ন, সে খবর বেনুদি জানে না। কিংবা কখনও জানতে পারবে না তার প্রতি বিশুদার স্বার্থহীন ভালোবাসার খবরটিও। সেই গাছটাতে আজ প্রথম ফুল ফুটেছে। বিশুদা শুনলে অসম্ভব খুশী হবেন। প্রথম ফুল ফোটার আনন্দে বেনুদি কি রকম ভাবে পুলকিত হয়েছে, আত্মহারা হয়েছে- সেসব শুনলে নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলবেন বিশুদা।

বিশুদা হয়তো শীঘ্রই বিয়ে করে সংসারী হবেন। তবুও হৃদয়ের অন্তপুরে কোথাও কি বেনুদি রয়ে যাবে? এই চন্দ্রমল্লিকার সৌরভ, এই চন্দ্রলোকের মায়াময়তা কি বিশুদার হৃদয়ে একটু খানি শান্তির সুবাতাস পৌঁছে দেবে? তার প্রত্যাশাহীন, প্রতিদানহীন ভালোবাসা কি এক অন্যরকম প্রাপ্তির আনন্দে কেঁদে উঠবে!


সাহিত্য >> গল্প ও ছোট গল্প