Choose your product from the mega showcase from thousands of sellers
BD Trade Blogs
> Blogs > কবিতা > অন্তর্দহন

অন্তর্দহন


অসীম তরফদার

গতকাল রাতে দুচোখের পাতায় একটুও ঘুম আসেনি
সারারাত এক অব্যক্ত যন্ত্রণার দুঃসহ আগুনে
পতঙ্গের মত ছট্ফট্ করে পুড়ে মরেছি আমি।
গতকাল রাতে কর্মক্লান্ত দেহটি বিছানায় এলিয়ে দিয়ে
কতবার তন্দ্রাদেবীর আরধনা করেছি,
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কতবার চেষ্টা করেছি
একটি ভালোবাসার কবিতা লিখতে
কতবার গলা ছেড়ে গাইতে চেয়েছি অমর প্রেমের গান;
অকারণ পায়চারী শেষে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কতবার শুনেছি
ঐ দূর আকাশে জেগে থাকা নক্ষত্রদের উপহাস!
তারপর আবার শুয়ে শুয়ে মৃত মানুষের মত চোখ বুজে
করেছি শুধু ঘুমের প্রার্থনা; তবু একফোঁটা সুপ্তি আসেনি;
শুধু অতীত থেকে ভেসে এলো বিবর্ণ কিছু ছবি,
অশ্রুভেজা দু’টি আঁখি আর একটি অসহায় মুখ।
গতকাল রাতে আকাশে চাঁদ উঠেছিল; দ্বাদশীর চাঁদ
ঘুমন্ত পৃথিবীর বুক রুপালী আলোয় ভরে দিয়েছিল
তার স্নিগ্ধ মায়াবী জোছ্না।
জোছ্নার মতই স্নিগ্ধ ছিল আমার অনন্যা-
আর এমনই কোমল ছিল তার মন।
খুব ভালোবাসতাম অনন্যাকে -
জীবনের চড়াই-উৎড়াই অথবা কুসুম ছাড়ানো পথ
শুধু তাকে নিয়েই পাড়ি দেবার স্বপ্নে বিভোর ছিল
আমার দুচোখ আর অবাধ্য এই মন।
আমাকেও ভীষণ ভালোবেসে তার অন্তঃপুরে বন্দি করেছিল অনন্যা,
চেয়েছিল তার ভালোবাসার মুঞ্জরী দিয়ে সাজাতে
আমাদের প্রতিটি আশান্বিত সকাল, উদাস দুপুর,
বিষন্ন বিকেল, ক্লান্ত গোধুলী, আধার ঘেরা রাত।

তার স্বপ্ন ছিল খুবই সাদামাটা, ইচ্ছেগুলো একেবারেই সাধারণ।
একদিন অনন্যাকে নিয়ে গেলাম ব্রক্ষ্রপুত্রের তীরে-
সেখানকার সৌন্দর্য্য দেখে অপার মুগ্ধতা ঝিলিক দিয়েছিল
তার ভ্রমরের মত কালো চোখ দুটোতে;
নদীর বুকে একটি সাম্পান দেখিয়ে সে বলল,
“দেখ, কি সুন্দর নৌকা !
বিয়ের পর আমরা এই ব্রক্ষ্রপুত্রেই আসব হানিমুনে,
এমনই একটি সাম্পান ভাড়া করে নদীর মাঝেই কাটাব
আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম তিনটি দিন ও রাত।”
এমন করে কত দিন অনন্যা সাজিয়েছে কত স্বপ্ন বুকের ভেতর
কত কথা বলে গেছে অফুরন্ত উচ্ছ্বাসে
এঁকে গেছে কত ছবি হৃদয়ের ক্যানভাসে!
এমন করে আমিও কত দিন অনন্যার কোলে মাথা রেখে
মোহাবিষ্ট হয়ে হারিয়ে গেছি স্বপ্নের গভীরে।

একদিন শ্রাবনের অপরাহ্ন বেলায়
আকাশে ভিড় করেছিল সাদা আর কালো মেঘেরা
বাতাস থেমে ছিল স্থির হয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায়,
একা ঘরে পথ চেয়ে বসে ছিল অনন্যা - আমি আসব বলে।
বৃষ্টি নামার আগেই বেরুবার আশায় উঠে পড়ি আমি
অনন্যা পথ আগলে দাঁড়ায় -
“বাইরে বৃষ্টি হবে ভেবে যাও যদি এখনই চলে
আমার হৃদয়ের উঠান তবে প্লাবিত হবে
বেদনার ঢেউ আর কান্নার জলে;
যাওনা থেকে তুমি আরও কিছু মুহুর্ত পাশে
না হয় গেলেই ভিজে শ্রাবন বর্ষণে
না হয় হল না করা কিছু অসমাপ্ত কাজ
না হয় কাটালে শুধু ভালোবেসে আজ।”

আমি সোফায় বসা
আর অনন্যা আমার শরীর ঘেষে সোফার হাতলে;
দমকা বাতাসে বৃষ্টির ছাট্ এসে লাগে জানলার কাঁচে
আলোর ঝলকানি দেয় বিজলীর চমক।
আমি সোফায় বসা
আর অনন্যা আমার কোলের উপরে;
অনন্যার শরীর থেকে এক অন্য রকম ঘ্রাণ আসে নাকে
আমি উন্মত্ত হয়ে গন্ধ শুঁকি অনন্যার সমস্ত শরীরের;
কামনায় বুজে আসে অনন্যার চোখ।
বাইরে শ্রাবনের পুঞ্জিভুত মেঘ অবিরল ধারায়
বৃষ্টি হয়ে ঝরে তৃষ্ণার্ত পৃথিবীর তপ্ত শরীরে,
আমরা দেহের উত্তাপ ভাগাভাগি করি অবরুদ্ধ ঘরে
কামনার সাগরে ডুবে পান করি অমৃত সুধা।
বৃষ্টির শীতল স্পর্শে মিটে যায় ধরণীর পিয়াস
জুড়ায় তার অঙ্গের জ্বালা।
“আমরা ভুল করিনিতো ?”
আমি পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করি তাকে।

বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেকেই চিনতে কষ্ট হল নিজের
নির্জন পথ ধরে অকারণ হেঁটে গেলাম মাইলের পর মাইল
একবার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে
মনে হল, অনন্যার কাছে যা কিছু চাওয়ার ছিল
কিংবা যা কিছু পাওয়ার, তার সবইতো পাওয়া হয়ে গেছে
তবে তাকে আর কি প্রয়োজন আমার ?
যাকে পাবার জন্য প্রতীক্ষা করেছি বছরের পর বছর
যাকে বিয়ে করে ঘরে তুলব বলে স্বপ্ন সাজিয়েছি বুকের ভেতর
যাকে জীবন সঙ্গিনী করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি
আর কথা দিয়েছি তার মাথায় হাত রেখে
সেই মুহুর্তে তাকেই হঠাৎ মনে হল বড্ড অপ্রয়োজনীয়!

শুরু হল জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো;
আর কখনও হইনি অনন্যার মুখোমুখি,
দেশ থেকে পালিয়ে যাই বিদেশের মাটিতে ।
কিন্তু যাবার ঠিক আগের মূহূর্তে জেনে গিয়েছিল অনন্যা,
বাড়ী থেকে বেরুবার পথে হঠাৎ এসে দাঁড়াল গাড়ীর সামনে
তার চোখ ভরা জল আর সমস্ত মুখে বেদনার মেঘ।
নিঃশব্দে কয়েকটি মূহুর্ত শুধু তাকিয়ে ছিল আমার চোখে
তারপর সরে গিয়ে হাত নাড়ল বিদায় জানিয়ে।
অশ্রুসিক্ত নয়ন যুগল আর মায়াবী করুন মুখখানি
পেছনে ফেলে আমি চলে গেলাম যদিও, তবু সেই
চোখ আর মুখের ছবিটি অজস্রবার চেষ্টা করেও
মুছতে পারিনি মন থেকে; তাই প্রবাস জীবনের ইতি টেনে
বছর না ঘুরতেই আমার ফিরে আসা।
কিন্তু ফিরে এসে আর পেলাম না আমার অনন্যাকে
সে যে কোথায় হারিয়ে গেছে, কেউ তা জানে না।
কাল বিকেলের ডাকে হঠাৎ তার চিঠি পেলাম, লিখেছে সে
“কেন তুমি এমন করলে - জানতে চাব না, অভিযোগও নয়,
শুধু একটি কথা জানাতেই লিখছি আজ -
এই মূহুর্তে আমার কোলে খেলা করছে তোমার সন্তান,
সে তোমার পিতৃ-পরিচয়েই বড় হবে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে;
তুমি ভয় পেয়ো না, তোমার পরিচ্ছন্ন জীবনে অবর্জনা হয়ে
কখনও আসব না আমি; তুমি ভালো থেকো।”

হ্যাঁ অনন্যা, আমি খুব ভালো আছি,
আমার চারদিকের বাতাসে কেবলই বিষের গন্ধ
বুকের মধ্যে এক জীবন্ত অগ্নিগিরি, অভিশপ্ত অগ্নিকুণ্ড।
গতকাল রাতের মত অসংখ্য রাত আমি কাটিয়েছি নির্ঘুম জেগে
অসংখ্য দিন নিঃশব্দে দগ্ধ হয়েছি শুধু তোমাকে ভেবে,
শুধু একটি ভুলের জন্য আজ প্রতি মূহুর্তে হৃদয় থেকে
উদ্গিরিত হচ্ছে লাভা, ক্ষরিত হচ্ছে রক্ত;
আর তোমার সেই অশ্রুসিক্ত দুচোখের অদৃশ্য আগুনে
দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত আমার সর্বাঙ্গ।
শুধু একবার তুমি ক্ষমা কর আমায়,
তোমার মমতার শীতল আঁচল দিয়ে শুধু একবার
নিভিয়ে দাও আমার বুকের এই অনল;
একবার তুমি ফিরে এসো অনন্যা, শুধু একবার;
আর কখনও ছেড়ে যাব না তোমায়, কথা দিচ্ছি
আমার সন্তান আর তোমাকে সযত্নে আগলে রাখব
সারা জীবন এই বিদগ্ধ হৃদয়ের মাঝে।


সাহিত্য >> কবিতা