এখন বরষার কাল,
নদীটি পরিপূর্ণ ভরা জোয়ারে।
বুকে তার অসীম জলরাশি, দূরন্ত গতি;
প্রবল স্রোতে সে বহমান সমুদ্র অভিমুখে।
একদিন বোশেখের পড়ন্ত বেলায়
নদীতে এসেছে সবে নবীন জোয়ার
আমার জীবনেও তখন নব যৌবনের আবাহন!
মধ্যাহ্নের-বৃষ্টিতে-সিক্ত বালুময় তটে
সেদিন হেঁটে হেঁটে চলে গেছি জলের কিনারে
ঠিক তখনই ওপারের এক মেয়ে
এপারে নামল এসে ছোট এক ডিঙিতে চড়ে।
চোখ দুটো তার যাদু জানে যেন!
খুব ভাসা ভাসা আর ডাগর ডাগর।
নদীর জলের মতই ঢেউ খেলানো চুল গুলো
কাশফুলের মত হাওয়ায ভেসে যায়।
নুপূর পড়া ফর্সা পায়ে সে হেঁটে বেড়াল
ভেজা বালুর উপর, উদাসী মনে।
মনে হল, স্বর্গের উর্বশী অথবা কোন স্বপ্নকুমারী
আমার হৃদয়ের তটে হেঁটে চলেছে
নুপূর পড়া দুটি পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে
রিনি-ঝিনি ছন্দে, আপন খেয়ালে!
মনে মনে ভাবি,
ওপারের মেয়ে, অথচ আগে কেন দেখিনি কখনো!
দেখা হলে আর কিছ না হোক আমার মনুষ্য জন্ম
হয়ত সার্থক হত আরও অনেক আগেই।
সে-ও লক্ষ্য করেছিল -
কেউ তাকে বিমুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছে দীর্ঘসময়।
তাই তাকে বঞ্চিত করেনি মোটেই;
বরং যাবার আগে মুচকী হেসেছে
একটু দুরে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলেছে-
“কাল এমন সময় আবার আসব।”
পশ্চিম গগনে সূর্যের আলো নিভে গেলে
চারিধার কেমন বিমূর্ত হয়ে ওঠে;
আমার ভেতরেও যেন এক বুক শূণ্যতা
নিঃশব্দে হাহাকার করে ওঠে।
পরের দিন আমি চলে যাই সময়ের আগেই;
তৃষিত আঁখি দুটি ওপারের পাণে চেয়ে থাকে অপেক্ষায়,
বুকের ভেতর কেমন ধক্ধসঢ়; ধক্ধসঢ়; করে ওঠে;
হয়ত আমায় তাকিয়ে থাকতে দেখে মজা করেছে-
আসলে সে আর আসবে না কোনদিন!
খানিক পরে হঠাৎ দেখি
নদীর মত জীবন অসীম তরফদার ১২-০৮-২০০৮ (পৃষ্ঠা ২/২)
মেয়েটি এসে উঠল ডিঙিতে;
তারপর নরম হাতে বৈঠা চালিয়ে ভিড়ালো এপাড়ে।
এবং এরপর থেকে সে প্রায়ই আসে
আর আমিও ঠিক সেদিনই যাই সে যেদিন আসে।
নদীটি তখন একদিন এমনই কানায় কানায়
ভরে গেল বর্ষার জলে; মনে হল-
আমার জীবন যেন এই নদীটির মতই
গ্রীষ্মের এক বিকেলে নদীর নব জোয়ারের মত
যে প্রেম উঁকি দিল আমার হৃদয়ে কোণে
বর্ষার ভরা মওসুমে সেই প্রেম যেন আজ
ফুলে উঠল দুকুল ছাপিয়ে, পূর্ণ জোয়ারে।
তারপর, পৌষের এক অপরাহ্নে
তার অপেক্ষায় বসে থাকলাম দীর্ঘ সময়
কিন্তু সে এলো না; যদিও তার আসবার কথা ছিল।
তারপরের দিনও এলো না, তারপরের দিনও নয়
এমন কি পরের মাসেও নয় ...
পৌষের নদী তখন স্রোতহীন, গতিহীন, নিশ্চল
বুকে তার কেবলই বালুচর।
আমার অবার মনে হল,
জীবনটা আমার সত্যি এই নদীর মতই।
কিন্তু পরের গ্রীষ্মে যখন নদীতে অবার এলো
নতুন জোয়ার, বর্ষায় এলো প্লাবন
তখন টের পেলাম,
নদীর সাথে আমার জীবনের পার্থক্য কত প্রকট!
নদীর জীবনে প্রতি গ্রীষ্মে নতুন করে আসে প্রাণ
বর্ষায় ফুলে ফেপে পরিপূণ হয় জোয়ারে
কিন্তু আমার জীবন !
সেই যে একবার পুর্ণ হয়েছিল প্রেমে ও মমতায়
তারপর গ্রীষ্ম আসে বর্ষা আসে
অথচ আমার জীবনে আর জোয়ার আসে না।
বার মাসই যেন আমার খড়া
সারা বছর আমার হৃদয়ে শুধুই বালুচর,
অসার শূণ্যতা আর নিষ্ফল হাহাকার।